সাইন্স ল্যাব পর্যন্ত বাসা হতে তিন মাস আগে রিকশা ভাড়া ছিল ৪০ টাকা। এরপর রিকশা ভাড়া চাওয়া শুরু করল ৫০ টাকা। দামাদামি করে ৪০ টাকায় দু এক জনকে রাজি করিয়ে কিছুদিন চালানো গেলেও এখন ৫০ টাকায় ও রিকশা পাওয়া যায় না। এক দাম ৬০ টাকা। তাও কঠিন। জ্যামের দোহায় দিয়ে অফিস টাইমে ৭০ টাকাও চায়।
প্রতিদিনের এরকম জীবন যুদ্ধে একটা উপলব্ধি এসেছে। বাংলাদেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যা ঘনত্ব বাজার ব্যাবস্থার বিশৃঙ্খলার অনেক কারনের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ একটি। আমি ৬০ টাকায় না গেলে, হয়ত আমার মত আর ১০ জনো ৬০ টাকায় যাবেনা। তবে হয়ত ১০ মিনিটের মধ্যে কেউ না কেউ ঠিকি ৭০ টাকায় যাবে। এই যে ৭০ টাকা দেয়া কাস্টমার আছে বলেই দাম কমানোর প্রেশার নেই।
কক্সবাজারে কোন এক হোটেলের প্রতি রাতের ভাড়া সর্বোচ্চ ৫৭ হাজার টাকা। ৫০% বা ৬০% ডিসকাউন্টে প্রতি রাতে ২২-২৫ হাজার টাকায় মানুষ থাকছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল আমার মত মানুষ এই দাম দেখে হয়ত স্বপ্নেও ওখানে থাকার কথা না ভাবলেও বাস্তবতা হল তাদের রুম খালি যায় না।
বাংলাদেশের কক্সবাজারে যেই হোটেল ৮ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যাবে এর থেকে ভাল মানের হোটেল থাইল্যান্ড বা অন্য কোন দেশে এর ৪ ভাগের এক ভাগ দামে পাওয়া যাবে। এক বেলা খেতে সেখানে জনপ্রতি ৫০০ টাকা পার হয়ে গেলেও ৩ দিনের একটা ছুটিতে হোটেলে স্থান দেয়ার জায়গা থাকেনা। এরপরো জিজ্ঞেস করলে সহজ সরল করুন উত্তর “ব্যবসা ভাল নেই ভাই, আগের মত নেই”।
সেদিন বাসায় ভাবলাম কদবেল কিনে নিয়ে যাই। দাম জিজ্ঞেস করতেই বলল বড় গুলা ১৫০, এর থেকে কিঞ্চিত ছোট ১২০ আর এপাশের গুলা ১০০। হা করে দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে বললাম ৮০ করে হবে? বলল এক দাম। দামাদামি নেই। আমি চলে আসলে আসলে কিছুই যায় আসেনা। অনেকেই কিনবে। আর অনেকে কিনবে বলেই ন্যায্যতার বালাই নেই বাজারে।
ঢাকার কোন কোন অঞ্চলে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৭০-৮০ হাজার লোকের বাস! এতটাই ঘিঞ্জি একটা শহরে রুপ দিয়েছি আমরা যে এখানে ক্রেতার কাছে বিক্রেতা দায়বদ্ধ নয়। ক্রেতা দায়বদ্ধ। রিকশায় গেলে যান, না গেলে নাই। কদবেল কিনলে কিনুন, না কিনলে নাই।
আমার উপলব্ধি হল, সারাবিশ্বে পণ্যের বাজার মূল্য নির্ধারনে কস্ট প্রাইস এর সাথে রিজনেবল প্রফিট মার্জিনের হিসাব করা হলেও, বাংলাদেশের বাজার ব্যাবস্থায় বাজার মূল্য নির্ধারন হয়, সর্বোচ্চ কত দামে ক্রেতার কাছে বিক্রি করে কত সময়ে স্টক খালি করা সম্ভব সেটির উপর। এক্ষেত্রে সময়কে মূল্য দিলে হয়ত একটু দাম কমায়। না দিলে বেশি দামেই বিক্রি চলবে।
পুরো বাজার ব্যাবস্থায় কার্যত কারো নিয়ন্ত্রন নেই। নিয়ন্ত্রন যারা করবে তাদের হয়ত মাথা ব্যাথাও নেই। বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে ব্যাচেলর হলে এক রকম, ভাড়াটের চাহিদা বেশি থাকলে ভাড়াও বেশি। কোন নির্দিষ্ট কাঠামোয় দাম নির্ধারন হয়না। কোন শৃঙখলায় আমাদের বাজার আবদ্ধ নয়।
সেদিন একটা ভিডিও দেখলাম, নিউমার্কেটে এক বিদেশির কাছে রাস্তার হকার বেল্টের দাম চাইছে ১৫ হাজার। ফিক্সড প্রাইস। অর্থাৎ প্রতি নিয়ত দাম নির্ধারনে আপনি কতটুকু বোকা বা চালাক সেটার ও পরীক্ষা দিয়ে পাশ ফেল করতে হবে।
কেন এরকম ভোগান্তি হবে? কেন একটা সুন্দর পরিকল্পনার আওতায় বাজার চলবে না? কেন ফটকাবাজিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে? এতে যারা প্রকৃত ব্যাবসায়ী তারা কিভাবে টিকবে?
এদেশে অনেকেই আছেন যারা আসলে বাজারে গেলে দাম ও জিজ্ঞেস করেন না। দামাদামি অনেকের কাছে ছোটলোকি। আমরা বুঝিনা আমাদের এরকম মাইন্ডসেট সাধারন ক্রেতাদের জন্য আরো ভোগান্তি সৃষ্টি করে। তবে প্রশ্ন হল, দামাদামিই বা কেন করতে হবে? ন্যায্যতা নিশ্চিত করলে তো দামাদামির প্রয়োজন হত না। তাইনা?
আমার প্রথম দিকের লেখায় পদ্মা সেতুর ইকোনমিক বেনিফিট নিয়ে লিখেছিলাম। সহজ ভাবে ওই সময় যেই দুটি জিনিস মাথায় এসেছিল তার ভেতর হল, এই সেতুতে দুরত্ব কমবে। একি সাথে ট্রিপ টাইম কমবে। কারো একটি ট্রাক থাকলে বা বাস থাকলে আগে ট্রাকের ক্ষেত্রে এক দিনে একটি ট্রিপ অথবা কখনো দুই দিনে একটি ট্রিপ খাটানোর বেশি সুযোগ পেত না। কিন্তু সেতু হলে দিনেই দুটি বা তিনটি ট্রিপ খাটানোর সুযোগ হবে। এতে আগে এক ট্রিপে ২০০০০ টাকায় ভাড়া খাটলে সেতু চালুর পর যদি সেই ট্রাক মালিক ৮-১০ হাজার টাকাও ভাড়া ধার্য করে তবুও তার আয় বৃদ্ধি পাবে। গাড়ির সংখ্যা না বাড়ালেও যাত্রী বা মাল বহন ক্ষমতা একি কারনে দ্বিগুন বা তিনগুন হবে। দুরত্ব কমায় তেল খরচ ও কমবে। ঘাটে ফেরি পেতে অনেক সময় যেই তেল পুড়ে সেই তেলেই ট্রিপ শেষ করা যাবে।
খবরে দেখলাম, কালনা সেতু উদ্বোধনের পর যশোরের সাথে ঢাকার দুরত্ব কমেছে ১১৩ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত যাত্রী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২.১৫ টাকা হিসাবে তাহলে খরচ কমার কথা ২২৮ টাকা। বর্তমানে পদ্মা সেতুর টোল, এক্সপ্রেসওয়ের টোল, অন্যান্য সেতুর টোল মিলিয়ে যাত্রী প্রতি টোল আসে মাত্র ৩৬ টাকা। যেখানে ভাড়া কমে ৩০০ টাকা হবার কথা, সেখানে বাসে ৬০০+ করে নিচ্ছে। এসি গাড়িতে ১২০০+। কি চমৎকার বাজার ব্যাবস্থা। তারা যানে যে তাদেরকে আইন দেখাবেনা কেউ। দেখালে ধর্মঘট। আর যাত্রী যারা এতদিন ৬০০ করে দিয়েছে তারাও ৬০০ করে হলেও দামাদামি করবে না। যাওয়ায় লাগবে। বিকল্প নেই।
চাহিদা অতিরিক্ত হলে সমস্যা। ছোট দেশে অতিরিক্ত ক্রেতা ঘনত্ব যে ঝুকির সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে অন্যতম আরেকটি হল ” প্যানিক” সৃষ্টির সুযোগ। মোটামুটি একটা প্যানিক বাজারে ছড়িয়ে দিতে পারলেও বিশাল মুনাফা। ধরবে কে? ধরার কেউ নেই। সিন্ডিকেট শক্তি তত বাড়ে যত ডিমান্ড বাড়ে। মাঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক ক্রেতা ও বিক্রেতা।
বাংলাদেশে বাজার শৃঙখলা নিয়ে ভাবা উচিত। এই পর্যন্ত বাজার শৃঙখলার উপায় নিয়ে বেশ কয়েকটি ভাবনা শেয়ার করেছি। আমার মনে হয়, জন দুর্ভোগ কমাতে আমাদের এই দিকটায় মনোযোগ দেয়া উচিত।
#wasimahin