বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে পৃথিবীর বহু দেশ থেকে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছুটে আসে টঙ্গীর তুরাগ ময়দানে। অথচ আমাদের দুভার্গ্য, বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যেই তৈরি হয়েছে ভয়ানক বিভাজন। সারাবিশ্বের মানুষের সামনে যদি বাংলাদেশের মুসলমানদের ঐক্যের এই অবস্থা হয়, তাহলে এটি আমাদের জন্য বিশ্ব লজ্জার বিষয়। কয়েক বছর আগেও ইজতেমায় সা’দ গ্রুপ—আলেম গ্রুপ বলে কোন বিভাজন ছিলনা। তাবলিগ জামায়াতের সাথে সাধারণত এদেশের দাড়ি পাকা, চুল পাকা শেষ বয়সী, নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুরুব্বীদের সম্পৃক্ততাই বেশি। এসব মানুষগুলো ধমীর্য় বিশ্বাসের উপর ভর করে তাবলিগে অংশ নেয়। তাবলিগের সাথে যুক্ত মানুষগুলো সাধারণত সামাজিকভাবে তেমন প্রভাবশালী নয়, ধমীর্য়ভাবে খুব বেশি শিক্ষিত বা পন্ডিত নয়, আর্থিকভাবেও যথেষ্ট স্বচ্ছল নয়। কয়েক গ্রামের সহজ সরল মুরুব্বী মানুষগুলো জড়ো হয়ে স্বেচ্ছায় তাবলিগের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অনেকের সফরে থাকাকালীন সময়ের খরচ মেটানোর সামর্থ্যও থাকেনা। তারা আল্লাহর নামে নেমে পড়েন এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। একজন সাধারণ মানুষ তাবলিগে যাওয়ার মনস্থ করলে তিনি নিজে খুব একটা ঘাটাঘাটি না করে, তারই কাছের মানুষের পরামর্শেই দলভুক্ত হয়। এভাবেই দিন দিন আলেম বা সা’দ পন্থীদের দলভুক্ত হয় মানুষ। এরা না বোঝে রাজনীতি, না বোঝে ইসলামী দলদারী। সিয়া, সুন্নি, আহলে হাদিস, জামাত, মাজহাব এসব ধারণায় তারা তেমন প্রভাবিত হয়না। শেষ জীবনে এসে সকল গোনাহের কথা স্মরণ করে, শুধু গোনাহমুক্ত হয়ে জান্নাতে দাখিল হওয়ার পথ খেঁাজে তারা।
আমাদের দেশে ফুটবল প্রেমীদের মধ্যে বেশীর ভাগই আর্জেন্টিনা—ব্রাজিলে বিভক্ত। এসব সমর্থকদের অনেকেই ব্রাজিল—আর্জেন্টিনার অন্য কোন বিষয়ে তেমন খেঁাজ—খবর রাখেনা। দেখা যায় শুধু একটি তারকা খেলোয়ারের জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে বা কোন দলের একটি খেলা দেখে অথবা একজন বয়জেষ্ঠ্য ভাই বা বন্ধুর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই কোন একটি দলকে সমর্থন করে। সেই দলকে ভালোবাসার এই শুরু। এরপর সারা জীবন ঐ দলের সমর্থনেই থাকবে। দলের সমর্থনে বাকযুদ্ধ, মারামারি এমনকি খুন খারাবীর ঘটনাও ঘটে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের ইগোটা খুব জোরালো ভুমিকা রাখে। একবার যে দলে যোগ দিয়েছি জীবন থাকতে আর পাল্টানো যাবে না। দল পাল্টানোর জন্য যত বেশি বল প্রয়োগ করা হবে, যত বেশি বোঝানো হবে, ফলাফল ততই উল্টো হবে।
বাংলাদেশের আলেমপন্থী ও সা’দপন্থী তাবলিগিদের ব্যাপারটিও অনেকটা এমনই। গ্রাম পর্যায়ের তাবলিগি দলের নেতৃত্ব দানকারী আমীরদের কেউ কেউ বেশ জ্ঞান রাখেন, কেউ কেউ মোটামুটি শিক্ষিত আবার কেউ তেমন শিক্ষিত বা ধমীর্য় জ্ঞানের অধিকারী না হয়েও শুধুমাত্র কয়েকটি একচিল্লা এবং তিনচিল্লা সম্পন্ন করার ভিত্তিতে ঐ এলাকার তাবলিগের আমীর হয়ে যান। ধমীর্য় শিক্ষা তেমন না থাকলেও কিছু লোক এসব আমীরের অনুসারী হয়ে পড়ে। একবার যদি কেউ আলেমপন্থী বা সা’দপন্থী দলের অনুসারী হয়েছে তাহলে তাকে যতই বোঝানো হোক, কথা তো শুনবেই না বরং সে দল পাল্টানোর বিষয়টি প্রেস্টিজের ব্যপার বলে মনে করেন তিনি। ঈমান থাকলো না গেল তাতে যায় আসে না, দলের সমর্থন রক্ষা করাই অধিক জরুরী বলে মনে করেন এসব হুজুগে সমর্থনকারী সাধারণ নিরীহ মানুষ।
তবে বাংলাদেশে সা’দপন্থীদের চেয়ে আলেমপন্থীরা তুলনামূলক একটু বেশি প্রভাবশালী হলেও যারা সা’দের অনুসারী তারাতো আমাদেরই পাড়া—মহল্লার, আমাদেরই কারো বাপ কারো চাচা বা প্রতিবেশী। আজ আলেম গ্রুপ না সা’দ গ্রুপ এই প্রশ্ন তুলে এসব বৃদ্ধ মানুষদের সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড় করানো মোটেই কাম্য নয়। এরা কেউ বুঝে আবার কেউ না বুঝে কারো কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি দলের অনুসারী হয়েছে। তাই বলে কি আজ দু’দলের সংঘর্ষে জড়িয়ে রক্তাক্ত হতে হবে এসব দাড়ি পাকা বৃদ্ধ মানুষগুলোর ?
বিশ্ব মেহমানদের সামনে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে এমন বিভাজন প্রকাশ পাওয়াটা আমাদের জন্য অত্যান্ত দুঃখজনক। দেশে একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই সাথে ইসকনের উস্কানীমুলক উগ্রতার কারণে তার ওপর আলেমগ্রুপ সা’দ গ্রুপের অস্থিরতার কারণে দেশ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ কঠিন ও সংকটাপন্ন সময়টি অতিক্রম করছে। এসময় আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দূরদশীর্ ও বিচক্ষণতার সাথে পদক্ষেপ নেয়াই এমকাত্র উপায়। পারস্পরিক সম্পর্কে একটু ফাটল ধরলেই শত্রুরা সুযোগ পাবে। এতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
আমাদের মধ্যে ধমীর্য় বিভাজন সৃষ্টি করবে আযানের ধ্বনি, শঙ্খের ধ্বনিসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের রীতি অনুযায়ী। সা’দের অনুসারী যারা তারাও তো এদেশেরই মানুষ, আযানের ধ্বনিতে শুনে মসজিদে যায়। তারা আমাদেরই স্বজন, প্রতিবেশি, ভাই—বন্ধু, বাপ—চাচা।
তাই এমন পরিস্থিতিতে দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে আলেমপন্থীদের এবছর কঠোর অবস্থানে না থেকে, তাদের সা’দপন্থী না ভেবে, আমাদেরই ভাই হিসেবে আলোচনা সাপেক্ষে তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এ বছর মিলেমিশে ইজতেমা সফল করার উদ্যোগ নেয়া হোক। একই সাথে দুই গ্রুপে ওয়াদাবদ্ধ হই যে, আগামী বছর আলেমপন্থীদের ধার্যকৃত দিনে সকলে মিলে ইজতেমা সফল করা হবে (ইনশাআল্লাহ)। দুই গ্রুপের এমন কঠোর অবস্থানে থাকাটা ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন দৃষ্টি কটু, তেমনি বিশ্ব ইজতেমার সৌন্দর্য নষ্ট করছে। আলেম বা সা’দের অনুসারী হলে কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে তা প্রত্যেকের নিয়্যত, ঈমান ও আমলের ভিত্তিতে আল্লাহ তালায়া ফয়সালা করবে।
তাই আসন্ন বিশ্ব ইজতেমায় আলেমদের এমন ছাড় ও সংযমী মানসিকতা সকল মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ করতে মহান দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য আহ্বানটি এই সংকটকালে আলেমপন্থীদের কাছ থেকে আসাই উচিত। এ বছর আলেমদের এ আহ্বানে যদি সা’দ পন্থীদের কাছ থেকে কাঙ্খিত সাড়া না পাওয়া যায় বা প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী আগামীতে সা’দপন্থীরা যদি আলেমপন্থীদের ডাকে সাড়া না দেয়, তাহলে সমস্যা চিহ্নিত হয়ে যাবে। দেশ বিদেশে বিষয়টি তুলে ধরা যাবে। তাদের অবস্থান সম্পর্কে সবাই বুঝতে পারবে।
আর যদি আগামী বছর আলেমদের সাথে মিলেমিশে ইজতেমা সফল করতে সা’দ পন্থীদের সমর্থন আসে, তাহলে এটা হবে বাংলাদেশে ইসলামের বড় বিজয়। তাই আমরা আশাকরি আলেমপন্থীরা এমন উদারতা দেখাবে। একই সাথে সারা বছর জুড়ে সকল মুমিন ও মুসলমানের খাস দোয়ার বরকতে হয়তো দেশের সকল মানুষের মধ্যে ঈমানী পরিবর্তন আসবে। হয়তো থাকবে না কোন ধমীর্য় বিভাজন।
লেখক- প্রাবন্ধিক।