ডলফিন বা শুশুক নদী ও সমুদ্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। ডলফিন আমাদের পরিবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক। জলজ বাস্তুসংস্থানের স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে এই প্রজাতির ওপর। বিশেষ করে মিঠা পানির ডলফিন জলজ প্রাণীদের খাদ্য শৃঙ্খল সুরক্ষিত রাখে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণ যখন আমাদের নদী, হ্রদ ও সাগরকে বিপর্যস্ত করে তুলছে, তখন ডলফিন একধরনের প্রাকৃতিক ‘সতর্ক বার্তা’ দেয়। যদি ডলফিনের সংখ্যা কমতে থাকে বা তাদের মধ্যে রোগ দেখা দেয়, তা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে দূষণ বা অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। তাই ডলফিনের অবস্থান এবং সংখ্যা পরিবেশের সঠিক অবস্থা জানার অন্যতম প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। তারা শিকারি হিসেবে দুর্বল ও অসুস্থ মাছ খায়, যা পানির জীববৈচিত্র্যকে স্বাস্থ্যকর রাখে। ডলফিনের এই শিকার করার প্রবণতা সমুদ্রের মাছের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ডলফিনের সংরক্ষণ সামুদ্রিক জীবনের অন্যান্য প্রজাতির জন্যও উপকারী, কারণ তাদের অনুপস্থিতি বা সংখ্যার হ্রাস সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য ডলফিন সমৃদ্ধ দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও মিঠাপানির ডলফিন সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর বন অধিদপ্তর কর্তৃক এ দিবসটি পালন করা হয়। ‘নদীর প্রাণ ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক’ প্রতিপাদ্যে ২৪ শে অক্টোবর আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস পালিত হবে। এ বছর দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে বন ভবন, আগারগাঁও, ঢাকা এর পাশাপাশি পাবনা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম, খুলনা বাগেরহাটেও বিভিন্ন জনসচেতনতামুলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আমাদের দেশে যে দুটি নদীর ডলফিন আছে তা হলো শুশুক ডলফিন আর ইরাবতী ডলফিন। আই.ইউ.সি.এন এর গ্লোবাল রেড লিস্ট ক্যাটাগরিতে দুটোই ঝুঁকিপূর্ণ ‘এন্ডেঞ্জার্ড এনিম্যাল’। ইরাবতীদের বাস আমাদের ৭২০ কি:মি: উপকূলীয় নদী কিংবা সাগরমুখে আর শুশুক ডলফিন বিচরণ করছে দেশে বিদ্যমান ৭০০ নদীর ২৪ হাজার কি:মি: এর একটি বড়ো অংশ জুড়ে। যদিও বর্ষামৌসুম ব্যতিরেকে শুষ্ক মৌসুমে এদের আবাসস্থল কমে বেশ সংকুচিত হয়ে যায়। এই নদীর ডলফিন সংরক্ষণে বিশ্বের ডলফিন রেঞ্জ দেশগুলোর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এর পদক্ষেপ কিন্তু অনেকটাই অগ্রগামী। আশার কথা হলো আমাদের ডলফিনের আবাসের জন্য বিস্তীর্ণ জলরাশি রয়েছে। আমাদের প্রমত্তা পদ্মা, যমুনা, মেঘনাসহ, ব্র্রহ্মপুত্র, হালদা, বলেশ্বর, গড়াই-মধুমতী, ডাকাতিয়া প্রভৃতি নদীই রিভার ডলফিনের উপযুক্ত আবাসস্থল। বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা ডলফিন ও নদী বাঁচাতে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর ডলফিনসহ অন্যান্য প্রজাতির ডলফিন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো নদীর দূষণ, অপ্রয়োজনীয় মাছ ধরার জাল, জলবিদ্যুৎ বাঁধ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর প্রবাহে পরিবর্তন। এদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, যা আমাদের বাস্তুসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলছে।ডলফিন সংরক্ষণ কেবল একটি প্রজাতি সংরক্ষণ নয়, বরং আমাদের পরিবেশের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যখন ডলফিনকে রক্ষা করা হয়, তখন তা জলজ পরিবেশের অন্যান্য প্রাণীদের জন্যও উপকার বয়ে আনে। বাংলাদেশ সরকার এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ডলফিন সংরক্ষণে বেশ কিছু কার্যক্রম শুরু করেছে। গঙ্গা নদীর ডলফিন সংরক্ষণে বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ডলফিনের বাস্তুসংস্থান উন্নত করার পাশাপাশি তাদের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে গাঙ্গেয় ডলফিনকে সংরক্ষিত প্রজাতির মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে, যা এদের রক্ষার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সুন্দরবন ডলফিনের নিরাপদ আবাসস্থল হওয়ায় ২০১২ সনের জানুয়ারি মাসে দেশের প্রথম তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষিত হয়। সুন্দরবনের চাঁদপাই, ঢাংমারী এবং দুধমূখী ডলফিন অভয়ারণ্যে যে কোনো সময় গেলেই ডলফিন দেখা যায়। সুন্দরবন এবং এর আশেপাশের এলাকায় ২০২০ সাল পর্যন্ত ডলফিন এবং জলজ প্রতিবেশ রক্ষায় সরকারের প্রথম প্রকল্পটি সত্যিকার অর্থেই একটি সফল প্রকল্প। যে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুন্দরবন নির্ভর জনসাধারণ বিশেষ করে জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ডলফিনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে হালদা নদীতে ডলফিনের সংখ্যা নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। বন অধিদপ্তরের টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের আওতায় ‘ডলফিন কনজারভেশন প্রোগ্রামস ইন যমুনা, হালদা এন্ড আদার ইম্পর্টেন্ট রিভারস’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, ডব্লিউসিএস বাংলাদেশ গাঙ্গেয় ডলফিনের উপর ব্যাপক পর্যালোচনা ও গভীরতার সমীক্ষা পরিচালনা করে। বাংলাদেশ মেঘনা ও এর শাখা নদী, পদ্মা, যমুনা, কর্ণফুলী এবং হালদা নদীর ১ হাজার ৯০৫ কিমি এলাকাজুড়ে নদীর ডলফিনের ভিজ্যুয়াল বোট-ভিত্তিক সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। দুটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক দল দ্বারা সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষার ফলে প্রায় ৬৩৬টি দল বা ১ হাজার ৩৫২টি গাঙ্গেয় ডলফিনের উপস্থিতি নির্ধারণ করা হয়। নদীর চ্যানেল, গভীরতা ও পানির গুণগত মান সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ১৬টি হটস্পট চিহ্নিত করে যেখানে গাঙ্গেয় ডলফিনের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে সাতটি হটস্পটকে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত, ডব্লিউসিএস সাতটি হটস্পটের মধ্যে পাঁচটি এবং একটি ডলফিন অভয়ারণ্যে গাঙ্গেয় ডলফিনের প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ সম্পর্কিত কেএপি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। কেএপি সমীক্ষার সময়, ডলফিন রেসপন্স টিমের সদস্যদেরও চিহ্নিত করা হয় যারা জড়ানো বা আটকে পড়া জীবিত ডলফিনকে উদ্ধার, মৃত্যুর ঘটনা রিপোর্ট এবং স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে প্রশিক্ষণ পাবেন। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য, ডব্লিউসিএস স্টিকার, পোস্টার, টি-শার্ট, ক্যাপ এবং সাইনবোর্ডসহ শিক্ষামুলক উপকরণ তৈরি করেছে, যা গাঙ্গেয় ডলফিন সংরক্ষণের বার্তাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে। দেশব্যাপী ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করার জন্য এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন অধিদপ্তর কর্তৃক শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিনকে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে ডলফিন সংরক্ষণ আরও গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা যায়। এর বাইরে, মিঠা পানির ডলফিন সংরক্ষণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। গবেষণা, ডলফিনের গতিবিধি ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং প্রজনন সংক্রান্ত উদ্যোগও গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন নদীতে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও নদী দূষণ রোধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ বাড়ানো হয়েছে। ডলফিন সংরক্ষণে সফলতা পেতে হলে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। প্লাস্টিক, রাসায়নিক পদার্থ, এবং অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য নদীতে ফেলার ফলে ডলফিনের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব হলো নদী ও সমুদ্র দূষণ বন্ধে সচেতন হওয়া। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা উচিত। জেলে সম্প্রদায়কে সচেতন করা প্রয়োজন, যাতে তারা ডলফিনদের সংরক্ষণের লক্ষ্যে জাল ব্যবহার করার সময় সতর্ক থাকেন। ডলফিন সংরক্ষণের জন্য নিরাপদ ও আইনসম্মত মাছ ধরার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নদী ও উপকূলীয় এলাকায় নৌযান চালানোর সময় ডলফিনদের প্রতি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে তারা দুর্ঘটনার শিকার না হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম ও স্থানীয় কমিউনিটির মাধ্যমে ডলফিন সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। বিভিন্ন সচেতনতামুলক প্রোগ্রাম, কর্মশালা, এবং প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মাঝে এ বিষয়ে ধারণা দেয়া যেতে পারে। নৌকাভ্রমণ বা পর্যটনের ফলে ডলফিনের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। পর্যটকদের ডলফিন দেখার ক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রাখা ও নির্দিষ্ট নিয়মাবলি মেনে চলা উচিত। বাংলাদেশে মিঠা পানির ডলফিন সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু আইন ও বিধিনিষেধ রয়েছে, কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
ডলফিন শুধু সমুদ্র ও নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, বরং আমাদের পরিবেশের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডলফিন শুধু পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখে না, তারা আমাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত জীবনের অংশ। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে ডলফিন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দায়িত্ব শুধু নিজেদের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও ডলফিনের এই সুন্দর প্রজাতিকে সংরক্ষণ করা। ডলফিন আমাদের জীববৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাদের রক্ষা করা আমাদের পরিবেশগত দায়িত্ব। ডলফিন সংরক্ষণে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। জনসচেতনতা, সরকারের কঠোর উদ্যোগ, এবং পরিবেশবান্ধব আচরণের মাধ্যমে আমরা ডলফিনদের রক্ষা করতে পারি। বিশ্ব ডলফিন দিবস উপলক্ষ্যে আসুন আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি, আমাদের নদী ও সাগরের এই অমূল্য প্রজাতিকে রক্ষা করে আমাদের পরিবেশকে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ রাখবো।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়