যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, ধ্বংস আর পোড়া গন্ধের বীভৎস বিস্তার। একুশ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝে এসেও বিশ্বজুড়ে হিংসা, হানাহানি, গোলাগুলি, গণহত্যা বন্ধ হয়নি। সর্বত্র যেন যুদ্ধের সাজ সাজ রব। মহাদেশজুড়ে থেকে বারুদের গন্ধ এখনও ভেসে আসছে। লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুকে বরণ করেছে যুদ্ধবাজদের নির্দয় লড়াইয়ে। ঘরবাড়ি ছেড়ে কোটি কোটি মানুষ শরণার্থী জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। অসহায়, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে দেশে দেশে বন্দরে। যুদ্ধের বিপরীতে শান্তির সুবাতাস বহে না কোথাও। যুদ্ধবিমুখ দেশ ও জাতিকেও জড়িয়ে যেতে হ”েছ বারুদের আবরণে, মৃত্যুর উপত্যকায়। আক্রমণাত্মক এবং ভয়ঙ্কর পরি¯ি’তি ক্রমশ তীব্র হ”েছ। মানুষের বাঁচার অধিকার হরণ করা হ”েছ। যেমন বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করেই ¯ি’ত নয়; নাগরিকদের নির্যাতন, নিপীড়ন এবং গণহত্যা চালিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করছে। বিশ্ববাসীর নিন্দায় তাদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না বলেই মিয়ানমার ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে। একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে তারা যে পথ বেছে নিয়েছে, তা বর্বরতারই নামান্তর। মানবতা সেখানে ভূলুণ্ঠিত। জাতিসংঘও পারছে না তাদের রেশ টেনে ধরতে। মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার সাত বছর পূর্ণ হলো। ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কর্মসং¯’ানহীন থাকা বিপুল এ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব আমরা নানাভাবে দেখতে পারছি।
একুশ শতকের প্রথম সংঘাত শুরু হয় এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানে। যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলার পর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়দাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে ২০০১ সালে দেশটিতে আগ্রাসন শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো। এরপর টানা দুই দশক ধরে চলে সেই যুদ্ধ। ২০২১ সালে পশ্চিমাদের সেনা প্রত্যাহার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী তালেবানের ক্ষমতা দখলের মধ্যদিয়ে সেই সংঘাতের আপাত অবসান ঘটে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত চলছে প্রায় ৭৬ বছর ধরে। সেই ধারাবাহিকতায় গাজা রক্তাক্ত হ”েছ বারংবার। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায়প্রতিদিন প্রাণ হারা”েছ শত শত মানুষ। এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে ইরান।
তিন বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধে ইতোমধ্যেই মারা গেছে কয়েক হাজার মানুষ এবং প্রতিনিয়তই মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হ”েছ। তারা পাশাপাশি দুটি দেশ। ইউক্রেনের প্রায় দশ লাখ মানুষ ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেছেন এবং তারা এখন শরণার্থীর জীবন যাপন করছে। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণে রাশিয়ারও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অনেক লোকজনও এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস বলছে, শিগগিরই হয়তো এ যুদ্ধ বন্ধের ই”ছা নেই ক্রেমলিনের। শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যব¯’া কিংবা জলবায়ু- সবকিছুই চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বন্দ্ব, চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব, জাপান-মার্কিন সম্পর্কের উন্নয়ন, রাশিয়া-চীন-ইরানের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক অচলাব¯’াসহ নানান অনিশ্চয়তা নিয়ে ধূম্রজালে বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন হতে চলেছে।
যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন ফরাসি সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ আন্দ্রে মারলো। তবে হতাশার বিষয়, তাঁর সেই মুক্ত ও স্বাধীন পৃথিবীর স্বপ্ন আজও অর্জিত হয়নি।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক ৩০ লাখ মানুষ শহিদ ও ২ লাখ নারী-শিশুর সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ-এর সৃষ্টি। “সবার সাথে মিত্রতা, কারও সাথে শত্রুতা নয়” এই নীতিকেই আকড়ে ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ (১) অনু”েছদে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় সার্বভৌম ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আইন ও জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা।’
সারাবিশ্বে ‘অহিংস আন্দোলন’ ও ‘যুদ্ধ-মুক্ত পৃথিবী’ নিয়ে কাজ করেছেন ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন।
হিংসা ও যুদ্ধবিগ্রহের পরিবর্তে ভালবাসা ও শান্তির পৃথিবী নির্মাণের মহান উদ্দেশ্যে মানবজাতিকে পরিচালনার লক্ষ্যে দার্শনিক ও হিউমানিস্ট মরিও রডরিজ কোবস সিলো (আর্জেন্টিনার নাগরিক) সত্তরের দশকে অহিংস আন্দোলনের সূচনা করেন। কালক্রমে তা সাংগঠনিক রূপ নিয়ে হিউমানিস্ট মুভমেন্ট নামে আর্জেন্টিনা থেকে পল্লবিত ও বিকশিত হয়ে আফ্রিকা, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
হিউমানিস্ট মুভমেন্ট সারাবিশ্বে ‘অহিংস আন্দোলন’ ও ‘যুদ্ধ-মুক্ত পৃথিবী’ গড়ে তুলতে মানবতাবাদী বার্তা নিয়ে ২০০৯ সালের ২ অক্টোবর নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন থেকে প্রথম ওয়ার্ল্ডমার্চ বের করে বিশে^র বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহর গুলোতে বিশ্ব পরিভ্রমণ অভিযাত্রা নিয়ে পরিভ্রমণ শুরু করে। ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর স্পেনের মাদ্রিদ থেকে দ্বিতীয় ওয়ার্ল্ডমার্চ যাত্রা শুরু করে। বছরব্যাপি ভ্রমণ শেষে গন্তব্যে পেীঁছে। এবছরের ২ অক্টোবর কোস্টারিকা থেকে যে তৃতীয় বিশ্ব পরিভ্রমণ যাত্রা শুরু হয় তা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা হয়ে পরিভ্রমণ করে স্পেনিশ নাগরিক রাফায়েল দ্য লা রুবিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ডেক্লেয়ার আরনালদো মেন্ডেজের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল ১৭ অক্টোবর সকালে বাংলাদেশে আগমন করবেন। পাঁচ দিনব্যাপি ওয়ার্ল্ড মার্চের অভিযাত্রা দল বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের হিউম্যানিস্ট সোসাইটির মানবতাবাদীদেরআয়োজনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করবেন। বিশ্ব পরিভ্রমণ দলটি ওশেনিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকা সফরের মাধ্যমে টানা ৯৫ দিন ভ্রমন শেষে আগামী বছরের ৫ জানুয়ারি কোস্টারিকায় গিয়ে ‘সান হোসে ডিক্লারেশনের মাধ্যমে সমাপ্ত করবেন।
মানবজাতির শান্তির স্বার্থেই আজ এই পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করতে হবে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি এবং এদের পরিচয় এখনÑ শরণার্থী। এসবই হ”েছ যুদ্ধের উপহার এবং অর্জন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায়জাতিসংঘকে যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরে আরও সুদৃঢ় অব¯’ানে পৌছাতে হবে। অহিংসতা ও যুদ্ধ কারও জন্যই সুখকর নয়। উন্নত জীবনমান ও শান্তিময় পৃথিবীই আমাদের কাম্য।
লেখক: গবেষক ও প্রেসিডেন্ট, হিউম্যানিস্ট সোসাইটি।