যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ জয়ে সবার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বন্ধু বলে অভিনন্দন বার্তা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বুধবার সন্ধ্যায় ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে নতুন করে ফিরে আসায় নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশ চাপে পড়তে পারে এবং ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে জটিলতা বাড়তে পারে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করায় গত ৫ আগস্টের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক। সে সময় স্বার্থ ঠিক রাখতে ওয়াশিংটন গণতন্ত্র, মানবধিকার এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকাকে বিভিন্ন ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা চাপে রেখেছিল। পতিত হাসিনা সরকারের শেষ কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপড়েন চলছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত তাদের নিজেদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে একাধিকবার আলোচনা করলেও বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের ইতিবাচক মনোভাব থাকায় ওয়াশিংটন-দিল্লি একমতে পৌঁছতে পারেনি।
গত ৫ আগস্টের পর হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেন। চিরায়ত প্রথা ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাতিসংঘ সম্মেলনের সাইড লাইনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করায় এখন বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে জটিলতা বাড়তে পারে। এই জটিলতা বাড়ার পেছনে একাধিক বিষয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রথমত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে ভারতে অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও রয়েছে হাসিনার। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশকে চাপে রাখতে পারে যাতে হাসিনাকে দেশে ফিরে রাজনীতিতে নতুন করে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
আগের মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভেদের সূত্রপাত ঘটান। ভারতের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক ভালো না। চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট (বিআরআই) উদ্যোগ কার্যকর হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে, এই কৌশলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অংশীদার এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকেও এই কৌশলে নিজেদের মতো করে পেতে চায়। বাংলাদেশ আবার চীনের বিআরআই উদ্যোগে এই অঞ্চলে সবার আগে যোগ দিয়েছে। পশ্চিমা চাপের ফলে পতিত হাসিনা সরকার বছর দুই আগে ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক প্রকাশ করেছে। বিআরআইকে কেন্দ্র করেই চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সুদৃষ্টিতে নাও দেখতে পারে এবং তখন বাংলাদেশকে ত্রিমুখী চাপে পড়তে পারে।
চলমান ভূরাজনীতিতে চীনকে ঠেকাতে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু স্বার্থ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই বলেছে যে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে আকসা ও জিসোমিয়া নামের দুটি মিলিটারি চুক্তি করতে চায়। এ বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এখনও আলোচনা চলমান। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ঠিক রাখতে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশকে চাপ দিতেই পারেন। এ ছাড়া গত ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাম্পের সমালোচনা করেন। বিষয়টি নিতান্ত হালকা বিষয় হলেও নিন্দুকরা উসকে দেওয়ার জন্য বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে পারেন। যেমনটি ঘটেছে গত সপ্তাহে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতিবাচক টুইট।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি মূলত তাদের দেশের সংস্থাগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করে ঠিক থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল দেশটির বৈদেশিক নীতিতে মোটা দাগে কোনো প্রভাব ফেলে না। যদি বিশ্বের কোথাও আমেরিকান স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখনই যুক্তরাষ্ট্র তাদের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তন করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনও এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি যাতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনবে। যেটি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ রক্ষায় দেশটির লবিস্ট গ্রুপ বা কংগ্রেসম্যানরা সময়ে সময়ে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি ভারতকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু ভারতের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র তখন বাংলাদেশকে কেমন চাপে রাখবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে ভারতের প্রভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে। তারপরও বাংলাদেশে যদি বড় ধরনের কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয়, যা আমেরিকান স্বার্থে আঘাত আনতে পারে তখন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরিই চাপ প্রয়োগ করবে। এ ছাড়া নির্বাচনের ফলাফলের কারণে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, ট্রাম্প জয়লাভ করায় ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে অন্তর্বর্তী সরকার অসুবিধায় পড়তে পারে। ট্রাম্প জয়লাভ করায় এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব বাড়বে। তখন নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্পকে দিয়ে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পুনর্বাসনের চাপ প্রয়োগ করতে পারে। ট্রাম্পের মেয়াদে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ঋণ পাওয়া কঠিন হতে পারে। এ ছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে তাড়াহুড়া করে নির্বাচন দিতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান এক নিবন্ধে বলেন, আমার মনে হয় না ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সম্পর্কের কাঠামোকে সমর্থন করবেন। যেমনটি বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে উন্নয়ন, সংস্কার ও অন্যান্য সহায়তা বা সমর্থন করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা প্রদানের ওপর জোর দেওয়ার মতো সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী হবে না।
গত ২০১৬ সালে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন তাদের রাজনৈতিক আদর্শ বা মতাদর্শের জায়গা ভিন্ন ছিল। বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করেন।
সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়বে, এমনটি মনে করি না। যদিও ট্রাম্প একটি টুইট করেছেন এবং এটি তার ভোটের বিবেচনায় ভারতীয়দের ভোট পাওয়ার জন্য করেছেন। আমি নিশ্চিত ট্রাম্প বাংলাদেশ কোথায় সেটিও জানে না। আমার মনে হয় না এটির কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে।
অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই। এবারের যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল বিভিন্ন কারণে সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু একটি দলের ওপর নির্ভর করে না। এখানে বাণিজ্যিক, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিকসহ বহুবিধ কারণ রয়েছে। শুধু প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হয়ে গেলেই এক দিনে এটি বদল হয়ে যায় না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রে যেই ক্ষমতায় আসুক বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না, খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও উচ্চ শেখরে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হবে। রিপাবলিকান অনেক নেতার সঙ্গেও প্রধান উপদেষ্টার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। গত সপ্তাহে ট্রাম্পের টুইট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আগে তাকে মিস ইনফর্ম করা হয়েছে। আমরা মনে করি ট্রাম্প এখন সঠিক পিকচার দেখবেন। মাইনরিটি নিয়ে মিস ইনফরমেশন ও ডিস ইনফরমেশন আছে।