১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে । এ দিনটিকে বিশ্বব্যাপি উদযাপন করা হয়। এই দিনে প্রিয়জনেরা একে অপরের সাথে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আগে ভ্যালেন্টাইন্স ডে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্য সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। বর্তমানে দিনটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। দিনটিকে বিশ্বব্যাপী আনন্দ উন্মাদনার সঙ্গে পালন করা হয়। । এই দিনে বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড় থাকে । সবাই নিজের মতো করে পালন করার চেষ্টা করে ।
এ দিনটিকে নিয়ে অনেক মতই চোখে পড়ে।
অনেকের ধারণা প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি রোমান দেব-দেবীর রাণী জুনোর সম্মানে ছুটির দিন।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র ইতিহাস অতি প্রাচীন। এর উৎস হচ্ছে আজ থেকে প্রায় ১৭শ’ বছর আগের পৌত্তলিক রোমকদের মাঝে প্রচলিত ‘আধ্যাত্মিক ভালোবাসা’র উৎসব। এ পৌত্তলিক উৎসবের সাথে কিছু কল্পকাহিনী জড়িত ছিল, যা পরবর্তীতে রোমীয় খ্রিস্টানদের মাঝে প্রচলিত হয়। এসব কল্প-কাহিনীর অন্যতম হচ্ছে, এ দিনে পৌত্তলিক (অগ্নি উপাসক) রোমের পৌরণিক কাহিনীতে বর্ণিত রোমিউলাস নামক জনৈক ব্যক্তি একদা নেকড়ের দুধ পান করায় অসীম শক্তি ও জ্ঞানের অধিকারী হয়ে প্রাচীন রোমে প্রাচীন রোমের প্রতিষ্ঠা করেন। পৌরাণিক এক কাহিনীকে কেন্দ্র করে ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি একটি জমকালো উৎসব পালন করতো রোমানরা। এ দিনে যেসব বিচিত্র অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হত তার মধ্যে অন্যতম ছিল, দু’জন শক্তিশালী পেশীবহুল যুবক গায়ে কুকুর ও ভেড়ার রক্ত মাখত। অতঃপর দুধ দিয়ে সেসব রক্ত ধুয়ে ফেলার পর এ দু’জন লোকের সামনে বের করা হত দীর্ঘ পদযাত্রা। এ দু’যুবকের হাতে চাবুক থাকত, যা দিয়ে তারা পদযাত্রার সামনে দিয়ে অতিক্রমকারীকে আঘাত করত। রোমান মহিলাদের মাঝে কুসংস্কার ছিল যে, তারা যদি চাবুকের আঘাত গ্রহণ করে, তবে তারা বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাবে। এ উদ্দেশ্যে মহিলারা পদযাত্রার সামনে দিয়ে যাতায়াত করত। রোমকরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পরও এ উৎসব উদযাপনকে অব্যাহত রাখে। তবে পৌত্তলিকতার খোলস পাল্টে তারা এ উৎসবকে ভিন্ন এক ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট করে। সেটা হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক জনৈক খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর জীবনোৎসর্গ করার ঘটনা। ইতিহাসে এরকম দু’জন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাহীনির সন্ধান পাওয়া যায়। এদের একজনের সম্পর্কে দাবি করা হয়, তিনি শান্তি ও প্রেমের বাণী প্রচারের ব্রত নিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। তাদের স্মরণে খ্রিস্টানরা তাদের উৎসবকে অব্যাহত রাখে। সময়ের আবর্তে ‘আধ্যাত্মিক ভালোবাসার’ উৎসব রূপান্তরিত হয় জৈবিক কামনা ও যৌনতার উৎসবে। তবে এ উৎসব খ্রিস্টধর্মের প্রাণকেন্দ্র ইতালিতে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আঠারো ও উনিশ শতকে তা পুনরায় চালু হয়। ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খ্রিষ্টান পাদ্রি বসবাস করতেন। তিনি চিকিৎসকও ছিলেন। ধর্ম প্রচার অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দি করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দি অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন।
এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল।
এরপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও প্রথম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন। খ্রিষ্টান জগতে পাদ্রি-সাধু সন্তানদের স্মরণ ও কর্মের জন্য এ ধরনের অনেক দিবস রয়েছে। এই হলো ১৪ ফেব্রুয়ারির সার-সংক্ষেপ ইতিহাস।
লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদের নানা উপাখ্যান। নিশীথ-কৃষ্ণকলি ‘লায়লা’র অনুরাগে শহরের দেয়াল বা কুকুরের গাল মজনুর কাছে প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি হলেও ‘সাইমুম (মরু) ঝড়ে’ চাপা পড়েছে তাঁদের প্রেমের সমাধি। জেগে উঠেছে কথিত ভালোবাসার জয় জয় গান। এক নোংরা ভালোবাসার উত্থান। ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে অনেক অনৈতিক কার্যক্রম চলে। পথেঘাটে বেহায়াপনা নির্লজ্জতা দেখা যায়।
তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ফুটে ওঠে উচ্ছ্বাসের সমারোহ। কতসব বিচিত্র আয়োজন হয় এই দিনে! দিন-রাতভর চলে আয়োজনের ঝলকানী। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের আছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। অথচ আমরা আমাদের সংস্কৃতির খোঁজ-খবর তেমনভাবে রাখি না যেমন বিদেশি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাই। যাইহোক পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে বেহাপনা ছড়ানো ইসলাম সমর্থন করে না। কোরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,” যারা মুমিনদের মাঝে অশ্লিলতা কামনা করে, তাদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন দুনিয়া ও আখিরাতের যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি”। -(সুরা নূর ১৪)
ভালোবাসা দিবসের নামে ইসলামবহির্ভূত কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিবাহের আগে তরুণ-তরুণীদের পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ, অবাধ মেলা-মেশা, প্রেম নিবেদন করা ইসলাম ধর্মে হারাম। তবে কাউকে ভালোবাসতে হলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসতে হবে। আবার কাউকে ঘৃণা করতে হলেও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করতে হবে। তাহলেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ আমল হল, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালবাসা এবং তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য কারো সাথে শত্রুতা রাখা। -মুসনাদে আহমদ,হাদিস নং ২০৩৪১।
মানুষের মনোদৈহিক প্রবণতা ভালোবাসা স্বভাবগত, গুণগত ও আদর্শগত কারণে হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমানদারের ভালোবাসা হতে হবে মহান আল্লাহ ও রাসুল স. –এর প্রতি নিবেদিত ও নিঃশর্ত। কেননা ভালোবাসার অপার শক্তিতে মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। আবার মহান আল্লাহর করুণা নির্ঝরিণী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.। তাই মহান আল্লাহ ও রাসুলের সা. প্রতি ভালোবাসার মূল্য বিপুল-বিশাল। ঈমানদারের ভালোবাসা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের বাণী– ‘মুমিনরা আল্লাহর ভালোবাসায় সুদৃঢ়।’ (সুরা বাকারা : ১৬৫) আবার আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্যই ভালোবাসতে হবে প্রিয় নবীকে (সা.)। কেননা মহান আল্লাহর বাণী : ‘(বলুন) যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে (আমি রাসুল) আমার আনুগত্য করো। তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)
মূলত ভালোবাসা পবিত্র জিনিস। মহান রবের পক্ষ থেকে এক বিশাল নিয়ামতও। এ নিয়ামত না পেলে আল্লাহ বান্দাকে, বান্দা আল্লাহকে, নবীজি উম্মতকে, উম্মতগণ নবীজিকে, পিতা-মাতা সন্তানকে, সন্তানগণ পিতা-মাতাকে ভালোবাসতো না। তাদের মধ্যে আত্মীয়তার নিগূঢ় সম্পর্ক তৈরি হতো না। মানুষ বঞ্চিত হতো বৈধ ভালোবাসার বন্ধন থেকে।
হাদিসে এসেছে, রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসলো, আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করলো, আল্লাহর জন্য কাউকে দান করলো এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকলো, সে ব্যক্তি নিজ ঈমানকে পূর্ণতা দান করলো। -আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৬৮৩।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে নবী-প্রেমে আসক্তি দান করে সকল কু-সম্পর্ক থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
লেখক: শিক্ষার্থী,খাষকাউলিয়া সিদ্দিকিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, চৌহালী সিরাজগঞ্জ।