আজ বুধবার ২৮ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রেনের উদ্বোধন করবেন। পরের দিন থেকে সকাল ও বিকালে ২ ঘণ্টা করে মোট ৪ ঘণ্টা চলবে মেট্রোরেল।
উদ্বোধনের দিন এই সড়ক দিয়ে উত্তরা উত্তর বা মেট্রোরেলের ১ নম্বর স্টেশনে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে প্রথমে তিনি সুধী সমাবেশে অংশগ্রহণ করবেন।
সুধী সমাবেশ শেষে মেট্রোরেলের ১ নম্বর স্টেশনসংলগ্ন নামফলকের উদ্বোধন করবেন। এরপর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে চড়ে আগারগাঁওয়ে মেট্রোস্টেশন হয়ে মেট্রোরেলের উদ্বোধনী কর্মসূচি শেষ করবেন।
আগারগাঁও মেট্রোস্টেশনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলেন, স্টেশনটি তিনতলাবিশিষ্ট। দ্বিতীয়তলায় বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় এমন দোকান বসানো হবে। ওই বাণিজ্যিক জায়গায় প্রস্তুতকৃত খাবার বিক্রি করা হবে। তবে আগুন জ্বালিয়ে সেখানে কোনো খাবার তৈরি করার সুযোগ থাকবে না। মেট্রোস্টেশন কম্পাউন্ডের ভেতর ধূমপানও নিষিদ্ধ। কেননা মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রিত এলাকার সামান্য পরিমাণ আগুন জ্বললেও অগ্নিনির্বাপণ পদ্ধতিতে বড় আওয়াজ করবে। বিদ্যুৎচালিত ট্রেনে আগুন জ্বালানোর সুযোগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কোথাও এই সুযোগ রাখা হয় না।
সব নাগরিকদের কথা বিবেচনা করেই মেট্রোরেল তৈরি করা হয়েছে। হেঁটে চলার সিঁড়ি, চলন্ত সিঁড়ি ও লিফটের ব্যবস্থা রয়েছে। বয়স ও শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনা করে এসব সুবিধা ভোগ করবেন যাত্রীরা। প্রতিবন্ধীরা লিফটে চড়বেন, বয়স্করা চলন্ত সিঁড়িতে চড়বেন এবং তরুণ ও যুবকরা সাধারণ সিঁড়ি বেয়ে মেট্রোস্টেশনে ওঠানামা করবেন।
বহু প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল বা এমআরটি-৬ এর উদ্বোধনের পর প্রাথমিকভাবে সকাল ও বিকালে দুই ঘণ্টা করে চার ঘণ্টা চলবে। উত্তরা উত্তর স্টেশন বা প্রথম থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে এই বিদ্যুৎচালিত এই উড়াল ট্রেন। এই পথের দূরত্ব ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। উদ্বোধনের দিনই এ দুটি স্টেশন খুলে দেওয়া হবে। সে মোতাবেক সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়েছে।
মেট্রোরেলের এই অংশের বাকি সাতটি স্টেশনও পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে খোলা হবে। যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনা করে মেট্রোরেলের শিডিউল নির্ধারণ করা হবে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত স্টেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে-উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ী), উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও। উদ্বোধনী দিন শুরুর ও শেষের মেট্রোস্টেশন খুলে দেওয়া হবে। পরে ধাপে ধাপে অন্য স্টেশনগুলো খোলা হবে।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন… আজ বহুল প্রতীক্ষিত দেশের প্রথম মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক চলাচল শুরু করতে যাচ্ছে মেট্রোরেল ঢাকাবাসীর কাছে আর স্বপ্ন নেই। ইতোমধ্যে এটি বাস্তবে রূপ নিয়েছে। যানজটের কারণে যখন রাজধানীবাসীর নাকাল হওয়ার দশা, তখন যেন স্বস্তির শীতল হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল।বাংলাদেশ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মাঝে মেট্রোরেল অন্যতম একটি প্রকল্প। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক নিজস্ব তদারকিতে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। করোনা সঙ্কট কাটিয়ে পুরোদমে বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পগুলো। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সুফল ইতোমধ্যে ভোগ করছে দেশবাসী।প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রতিশ্রুতি দেশবাসীকে দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি অটুট।আর মেট্রোরেল মূলত একটি স্পীড ট্রানজিট বা দ্রুতগামী যোগাযোগ ব্যবস্থা। যা বিশ্বের অনেক প্রধান শহরেরই বহুল ব্যবহৃত পাবলিক ট্রান্স পোটেশন সিস্টেম হিসেবে।
> মেট্রোরেল:-
মেট্রোপলিটন রেল-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হলো মেট্রোরেল। মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো স্পর্শ করে গণপরিবহনের জন্য প্রতিষ্ঠিত রেলব্যবস্থাই মেট্রোরেল। একে র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেমও বলা হয়। এটি একটি বিদ্যুৎচালিত, দ্রুতগামী, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও নিরাপদ নগরকেন্দ্রিক রেলব্যবস্থা। আধুনিক নগর পরিকল্পনায় ও যানজট নিরসনে বিপুল সংখ্যক যাত্রী দ্রুত পরিবহনে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম মেট্রোরেল ।
> ইতিহাস
১৮৬৩ সালে লন্ডনে প্রথম দ্রুত ট্রানজিট রেলব্যবস্থা চালু করা হয়, যা এখন ‘লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর একটি অংশ। ১৮৬৮ সালে নিউইয়র্কে প্রথম দ্রুত ট্রানজিট রেলব্যবস্থা চালু হয় ৷ ১৯০৪ সালে নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়ে প্রথমবারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান প্রথম ১৯২৭ সালে পাতাল রেলব্যবস্থা তৈরি করে। ১৯৭২ সালে ভারতের কলকাতায় মেট্রোরেল নির্মাণ শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি দ্রুত ট্রানজিট রেলব্যবস্থা চালু রয়েছে।
> বাংলাদেশে মেট্রোরেল
বাংলাদেশে মেট্রোরেল সম্পূর্ণরূপে একটি নতুন ধারণা। যানজট নিরসন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার তৈরি করে ‘ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথোরিটি’। ঢাকায় নির্মাণাধীন শহরভিত্তিক রেলব্যবস্থা হচ্ছে ঢাকা মেট্রোরেল যা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট’ বা এমআরটি (MRI) নামে পরিচিত। ২০১৩ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, যার অধীনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (DMTCL)। এটি ৩ জুন ২০১৩ প্রতিষ্ঠা করা হয় । এটি সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।
> নির্মাতা প্রতিষ্ঠান
মেট্রোরেলের ২৪ সেট ট্রেনের নকশা প্রণয়ন ও তৈরির দায়িত্বে রয়েছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ DMTCL এবং কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়ামের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছয়টি কোচ নিয়ে একটি ট্রেন সেট গঠিত। ২১ এপ্রিল ২০২১ জাপান থেকে মেট্রোরেলের প্রথম সেট বাংলাদেশে পৌঁছে। মেট্রোরেল ও লাইনের নকশা অনুযায়ী, এটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে।
> প্রকল্পসমূহ
DMTCL’র আওতায় মেট্রোরেলের মোট দৈর্ঘ্য ১২৯.৯০১ কিমি (উড়াল ৬৮.৭২৯ ও পাতাল ৬১.১৭২ কিমি) এবং স্টেশন ১০৫টি। এ লক্ষ্যে সরকার ২০৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
> প্রথম মেট্রোরেল
মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পথটি ‘এমআরটি লাইন-৬’ নামে পরিচিত। এটি ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল। ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার সাথে বাংলাদেশ সরকার এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৩৩,৪৭১.৯৯ কোটি টাকা । উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা Japan International Cooperation Agency (JICA) এ প্রকল্পে সহায়তা দিবে ১৯,৭১৮.৪৭ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার দিবে ১৩,৭৫৩.৫২ কোটি টাকা।
এমআরটি লাইন-৬ সংশোধিত বাস্তবায়ন পরিকল্পনা :
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৬) বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল ২০১২-২০২৪ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয় । মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিশেষ উদ্যোগে নির্ধারিত সময়ের ২ বছর ৬ মাস পূর্বে বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল চালুর সংশোধিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রথম ধাপে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলবে। এ অংশের মোট দৈর্ঘ্য ১১.৭৩ কিলোমিটার এবং স্টেশন রয়েছে নয়টি । ১০টি ট্রেন দিয়ে এ অংশে শুরু হবে যাত্রী পরিবহন। ভোর ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চার মিনিট অন্তর চলাচল করবে ট্রেনগুলো। প্রতিটি স্টেশনে থামবে ৪৫ সেকেন্ডের জন্য। আগারগাঁও পর্যন্ত ভ্রমণ করা যাত্রীদের মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য রাখা হবে ‘শাটল’ বাস । একইভাবে শাটল বাস রাখা হবে উত্তরা নর্থ স্টেশন থেকেও।
> বিদ্যুৎ
মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ আসবে সরাসরি জাতীয় গ্রিড থেকে । এজন্য উত্তরা ও মতিঝিলে দুটি ১৩২ কেভি উপকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। উত্তরা-আগারগাঁও পর্যন্ত ৮০ মেগাওয়াট আর আগারগাঁও- কমলাপুর পর্যন্ত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জোগান থাকবে ।
> মেট্রোরেল সুবিধা সমূহ:-
ঢাকা শহরের মতো জনবহুল ও যানজটের শহরে মেট্রোরেল যেন নগরবাসীর জন্য এক আশীর্বাদ। মেট্রোরেলের কারণে ঢাকা শহরবাসী নিম্নোক্ত সুবিধাগুলো ভোগ করবে—
বিপুল সংখ্যক লোক খুব সহজে এবং দ্রুত এক স্থান থেকে অন্যত্র ভ্রমণ করতে পারবে।
সম্পূর্ণ যানজটবিহীন একটি পরিবহন ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটবে।
যাতায়াতের সুবিধার জন্য মূল ঢাকায় বসবাসের ওপর চাপ কমবে।
এতে শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকায় যাত্রীরা একটি শব্দ দূষণমুক্ত পরিবেশে ভ্রমণ করতে পারবে।
মেট্রোরেল হাজার হাজার কর্মঘণ্টা সাশ্রয় করবে যে সময় উন্নয়নশীল কাজে ব্যয় করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখা যাবে।
অন্যান্য পরিবহনের চেয়ে নিরাপদ ও সর্বনিম্ন দুর্ঘটনার যোগাযোগ মাধ্যমে পরিণত হবে মেট্রোরেল।
মেট্রোরেল ব্যবহারের কারণে রাস্তায় যানবাহনের চাপ কমবে, এতে ঢাকা শহর আগের চেয়ে আরও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে
মেট্রোরেল চালু হলে ছোট ছোট যানবাহনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানির ব্যবহার বহুলাংশে হ্রাস পাবে। এতে বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে যাবে।
> অর্থনৈতিক প্রভাব:-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। দেশের সম্পূর্ণ জিডিপিতে ঢাকার অবদান প্রায় ৩৬%। ৩০ জুন ২০২২ পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১৮,৭৭,৪৭৪টি। ঢাকা মহানগরীর সড়ক ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৬.১২ কিমি.। এতে মহানগরীর যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই যানজট ও এর ফলশ্রুত প্রভাবে বার্ষিক প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে মেট্রোরেল চালু হলে যানজট ও এর ফলশ্রুত প্রভাবে যে ক্ষতি হচ্ছে তা সাশ্রয় হবে। এছাড়া মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় অনেক নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও নতুন আবাসন গড়ে উঠছে এতে অসংখ্য মানুষের নতুন কর্মস্থল তৈরি হবে।
> ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:-সরকারের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ২০৩০ অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ জেলাকে মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। ২০৩০ পরবর্তী প্রথম পর্যায়ের পরিকল্পনায় গাজীপুর জেলা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলাকে মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ২০৩০ পরবর্তী পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর সঙ্গে ঢাকা জেলার পার্শ্ববর্তী ৫টি জেলাকে মেট্রোরেল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করা। মেট্রোরেল নগরবাসীকে খুব কম সময়েই গন্তব্যে পৌঁছে দেবে এবং একই সাথে নগরজীবনে ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ করবে। মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নয়ন হবে তেমনি ঢাকার মর্যাদাও বেড়ে যাবে। যোগাযোগের নতুন সূচকে ঢাকা এগিয়ে যাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। মেট্রোরেল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে পৌছে দিবে এক অনন্য উচ্চতায়।
> মেট্রোরেল ভাড়া নির্ধারণ:-
সরকার মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করেছে ২০ টাকা। আর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া হবে ১০০ টাকা। প্রথম পর্যায়ে মেট্রোরেল যে অংশে চলাচল শুরু করবে, সেই উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশনের ভাড়া হবে ৬০ টাকা। উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে উত্তরা সেন্টার (মধ্য) ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের ভাড়া একই—২০ টাকা। এ ছাড়া প্রথম স্টেশন (উত্তরা উত্তর) থেকে পল্লবী ও মিরপুর-১১ স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৪০ টাকা এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বর্তমানে ঢাকার বাস-মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। যাঁরা এখন সর্বনিম্ন এই ভাড়া দিয়ে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে নেমে যান, তাঁদের জন্য মেট্রোরেলের ভাড়া কিছুটা বেশিই মনে হবে। আবার যাঁরা রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা রাইড শেয়ারিংয়ে চলেন, তাঁদের জন্য মেট্রোরেলের ভাড়া সাশ্রয়ী হবে। কারণ, ঢাকায় এখন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় স্বল্পদূরত্বেও ১৫০ টাকার আশপাশে ভাড়া দিতে হয়।
যাত্রীর ইচ্ছামতো গন্তব্যে অটোরিকশাচালক যেতে রাজি হন না। অন্যদিকে ঢাকায় রিকশার ভাড়া এখন কমপক্ষে ২০ টাকা। এর বিপরীতে মেট্রোরেল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) হবে। ফলে যাতায়াত আরামদায়ক হবে। স্মার্ট কার্ডে ভাড়া পরিশোধ করলে ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে ডিএমটিসিএল।
কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে, সাপ্তাহিক, মাসিক, পারিবারিক কার্ড আগে থেকে কিনতে হবে। মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে থাকা যন্ত্রেও কার্ডে টাকা ভরা (রিচার্জ) যাবে। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সময় যাত্রীদের কার্ড পাঞ্চ করতে হবে, তা না হলে দরজা খুলবে না। এরপর নেমে যাওয়ার সময় আবার কার্ড পাঞ্চ করতে হবে, তা না হলে যাত্রী বের হতে পারবেন না। আরেকটি কার্ড সাময়িক, যা প্রতি যাত্রায় দেওয়া হবে। স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ভাড়া দিয়ে এ কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। এটিও স্মার্ট কার্ডের মতো। ভাড়ার অতিরিক্ত যাতায়াত করলে ওই কার্ড দিয়ে দরজা খুলতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকা কর্মীদের কাছে বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করেই বের হতে হবে। স্টেশনে টিকিট বিক্রির দুটি কাউন্টার থাকবে। এর একটিতে সাধারণ মানুষ টিকিট কিনতে পারবেন। অন্যটিতে কেনার সুযোগ পাবেন শারীরিক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা।
উল্লেখ্য,বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ২০১২ সালে মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ করে। ২৬ জুন ২০১৬ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।২০১৭ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। জাপানি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা-জাইকা এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। আর মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য প্রথম বছরে সরকার বরাদ্দ করেছে ১ হাজার কোটি টাকা।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বেশি দৃশ্যবান প্রকল্প ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প। অন্যটি হচ্ছে পদ্মা সেতু। তাও নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ। যে পদ্মা সেতুতে অর্থনৈতিক ঋণ বিশ্বব্যাংকের দেয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ কাজ শুরু করে। সরকার এই ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল এবং সফলও হয়েছে। এ সফলতার ফল আমরা সবাই ভোগ করছি।ঠিক তেমনি ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প ঢাকা শহরের মানুষের অনেক দিনের কষ্ট লাঘব করে জীবনমানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এই জাতীয় প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদী। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে সরকার বদ্ধপরিকর। দুর্নীতিমুক্ত কর্মকা- সবার কাম্য। যত বেশি দুর্নীতিমুক্ত কাজ হবে, তত বেশি উন্নয়ন সঠিক হবে। ব্যয় হ্রাস পাবে। দেশের অর্থনীতিতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায় সময় বেশি লাগার কারণে। সময় বেশি লাগার ফলে দুর্নীতিও বেড়ে যায়। চাই দক্ষ, সৎ ও দেশপ্রেমিক কর্মীবাহিনী।আর গত ১৪ বছরে যারা শেখ হাসিনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন তারা এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন। তার নেতৃত্বের গুণাবলী শুধু দেশের জনগণের মধ্যে প্রশংসিত হয় নি, বরং তার নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছেন বিশ্ব দরবারে। বাংলাদেশের নেতা থেকে তিনি বিশ্ব নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশের ভেতরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীর ক্ষমতায়নসহ অনান্য বিষয়ে তিনি সব সময় সরব থেকেছেন বিধায় আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা তার কাজের প্রশংসা করেছেন। এমনকি তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতারা প্রশংসা করেছেন। কোভিড-১৯ মোকাবেলাই সরকারের সফলতা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে। আর আমাদের বাংলাদেশে প্রায় ১৭কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের আজকের যে অবস্থান সেটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে তার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের কারনে। তবে তার এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করেছে সরকারের ধারাবাহিকতা কারণ বাংলাদেশের মতো দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের জনগণ তার ওপরে আস্থা রেখে তাকে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবার সুযোগ করে দিয়েছে। ২০৪১ সাল নাগাদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের নতুন একটি রূপকল্প দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। সেই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে, মেট্রোরেলসহ সমন্বিত আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
লেখক-কলাম লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্রতিষ্ঠাতা,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল, drmazed96@gmail.com