বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিওটি সদস্য বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো আর্থিক সুবিধা নিতে পারবেন না। তবে দেশের কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়মে জর্জরিত বলে প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়। অলাভজনক ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার কথা থাকলেও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতোই চালাচ্ছেন- এমন অভিযোগ আছে। পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের তোয়াক্কা না করার অভিযোগ উঠেছে দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে।
বৃহস্পতিবার সময়ের আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, শুধু রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নিযুক্ত বৈধ উপাচার্যই মূল সনদপত্রে সই করতে পারেন। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সনদপত্রে সই করতে পারেন না। তবু বছরের পর বছর বৈধ উপাচার্য ছাড়াই চলছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। দেওয়া হচ্ছে সনদও। আইনের বিধান মতে, সব ব্যয় ভাউচার, দেনা পরিশোধ, সব অর্থ লেনদেনে চ্যান্সেলর নিযুক্ত ট্রেজারারের সই থাকতে হবে। বাস্তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ ট্রেজারার নেই। একাডেমিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে ও শিক্ষার মান বজায় রাখতে উপ-উপাচার্য থাকারও বিধান রয়েছে আইনে। দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও মাত্র ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য অনুমোদিত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের পদ পূরণ করেছে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার ছাড়াই দিব্যি চলছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) আদেশ, নির্দেশকেও পাত্তা দিচ্ছে না তারা। শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ৭৭টিতে উপ-উপাচার্য এবং ৪৮টিতে ট্রেজারারের পদ শূন্য। তবে এর মধ্যে ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও ট্রেজারারের উভয় পদই খালি। ১০টিতে তিন পদেই কেউ নেই। শূন্য এসব পদ পূরণের জন্য নামের প্যানেল প্রস্তাব পাঠাতে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল সব বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। ২৩ আগস্ট আবার তাগিদপত্র দেওয়া হয়।
আইন অনুযায়ী অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট দাখিল করছে না। এ ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়ে প্রকৃত তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এত সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দরকার নেই। হাতে গোনা ৫-৬টি ছাড়া অন্যগুলোতে কোনো লেখাপড়া হয় না। কেবল ছাত্র ভর্তি করে ক্লাস করায় আর সার্টিফিকেট বিক্রি করে। এতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
বস্তুত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মালিক পক্ষের খামখেয়ালিপনা ও ক্রীড়নকে পরিণত হওয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মালিকানা দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে নামকাওয়াস্তে পাঠদান, কোচিং সেন্টারের আদলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, ভাড়ায় শিক্ষক এনে জোড়াতালির ক্যাম্পাস পরিচালনা, সনদ বিক্রি, ক্যাম্পাস ও শাখা বিক্রিসহ দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন সব কীর্তিকলাপ চলছে, যা এককথায় ভয়াবহ। উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে এরকম নৈরাজ্য চলতে থাকলে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই।
নিজস্ব ক্যাম্পাসের পাশাপাশি প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক, পাঠাগার ও গবেষণাগারসহ সমন্বিত পাঠদানের জন্য আনুষঙ্গিক সবকিছুই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা প্রয়োজন। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা ও জ্ঞানচর্চার মুক্ত পরিবেশ এবং সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের আর দশটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেভাবে চলে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও যদি সেই একই চিত্র বিরাজ করে, তাহলে উচ্চশিক্ষায় নৈরাজ্য সৃষ্টিকেই উৎসাহ দেওয়া হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিরাজমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা দূর করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দেবে- এটাই প্রত্যাশা।