আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত না হওয়ায় সড়কে কোনোভাবেই শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। যে যেমন খুশি সড়কে চলছে ফলে প্রতিদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, যা দুঃখজনক।প্রতিদিন সড়কে প্রাণহানির খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। সম্প্রতি প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪০৭টি, এর মধ্যে ১৮২টিই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৬৯ জন, যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাব মতে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ২১ হাজার ৬৬২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। গত সাত মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৪৫১টি। এর অর্ধেকের বেশি ১ হাজার ৩৫১টি দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাস, ট্রাক ও মোটরসাইকেল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটির তথ্য মতে, হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি। আর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি হয় ৫.৩ শতাংশ। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩ হাজার ৫০২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।
এই পরিসংখ্যানগুলো খুবই উদ্বেগজনক। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছেই। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের বেপরোয়া গতি। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে ছোট যানবাহন বন্ধ ও বেপরোয়া যানবাহন চলাচল বন্ধে সাফল্য নেই। বাস্তবতায় মনে হয় আইন শুধুমাত্র কাগজেই হয়তো সীমাবদ্ধ আছে, প্রয়োগ নেই।
রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে ১০ লাখ নছিমন-করিমন-ইজিবাইক। অবাধে আমদানি হচ্ছে অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক। দেশব্যাপী অন্তত ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, হিউম্যান হলার অবাধে চলছে। নিবন্ধনবিহীন কয়েক লাখ অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে সড়ক-মহাসড়কে। আর এগুলোর চালক অধিকাংশই অদক্ষ, এসব যানবাহনই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান উৎস বলে মনে করি। এদেশে দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির নজিরও তেমন নেই বলেই চলে। যার ফলে চালকরা ইচ্ছামতো গাড়ি চালান। হাই রিস্ক নিয়ে ওভারটেক করেন। এ ছাড়া চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়কের অধিকাংশ ফুটপাতগুলো হকার দিয়ে ঠাসা, ফলে ফুটপাত দিয়ে মানুষ চলাচলের অবস্থা নেই। কাজেই মানুষ বাধ্য হয়ে মূল রাস্তায় হাঁটছে এবং দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। ফুটপাটগুলো দ্রুত হকারমুক্ত করতে হবে। বাসে সিট বেল্ট বাঁধার ব্যবস্থা, হেলমেটের ব্যবহার কম থাকায় ছোটখাটো দুর্ঘটনায়ও প্রাণহানি ঘটছে। ইদানীং মোবাইল ফোন কানে রেখে গাড়ি চালানো যেন চালকদের ফ্যাশনে পরিনত হয়েছে । যদিও এ কাজ থেকে বিরত রাখতে আইন আছে। কিন্তু সে আইনের ব্যবহার হয় না। এ কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর অনুমোদন দিয়েছেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পরিস্থিতির উন্নতি তো দূরের কথা, ন্যূনতম শৃঙ্খলা নেই কোথাও। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও তা দীর্ঘদিনেও পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। পরের বছর নভেম্বরে নতুন আইনটির প্রয়োগ শুরু হলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এতে সরকার আইনটি সংশোধনের আশ্বাস দেয়। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে ঢাকা মহানগরীতে ট্রাফিক পুলিশ সীমিত আকারে আইনের প্রয়োগ করলেও সারাদেশে অনেকটা স্থবির অবস্থা রয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সমাধানের অযোগ্য কোনো বিষয় নয়।
এ প্রসঙ্গে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার আইন করেছে কিন্তু বিধিমালা করেনি। বিধিমালা না হওয়ার কারণে আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। তাদের মতে, সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা চান না এই আইনটি কার্যকর হোক। কারণ আইনটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরলে এক শ্রেণির নেতার চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়ে যাবে।
এমন এক পরিস্থিতিতে সড়ক পরিবহন বিধিমালা দ্রুত জারি ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অধিক জরুরী বলে মনে করি । এজন্য দরকার সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক চিন্তা ও সমন্বিত পদক্ষেপ। বিশেষ করে মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের কঠোর নজরদারি জরুরি। মোট দুর্ঘটনার প্রায় অর্ধেকই যখন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা তখন এর রাশ টেনে ধরতেই হবে। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারী যেই হোক না কেন তার জরিমানা ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের পাশাপাশি যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার করতে হবে।
লেখক- কলামিষ্ট।