বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত-‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’র পর সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি /আমি কি ভুলিতে পারি’। এ অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রথম সুরকার আব্দুল লতিফ ও বর্তমান সুরকার আলতাফ মাহমুদ। এ তিন গুনীজনই বরিশালের সন্তান। বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ার সন্তান, যার বয়স ছিল সেসময় মাত্র ১৮ বছর, পড়তেন ঢাকা কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে, সেই আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এই গানটি কিভাবে কোটি কোটি বাংলা ভাষাভাষির গান হিসেবে স্থান করে নিল, সেকথাই তুলে ধরার চেষ্টা করব এ লেখায়। আবদুল গাফফার চৌধুরী ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তার ৮০ তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমিতে একুশের গানের উৎপত্তি নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অনেকটা এরকম- ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকার তৎকালীন প্রাদেশিক আইন পরিষদ ভবনের (বর্তমান জগন্নাথ হল) সামনে গুলিবর্ষণ করা হয়। শহীদ রফিকের লাশ পড়ে আছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহি:বিভাগের বারান্দায়। তার মাথার খুলি উড়ে গেছে গুলিতে। এই খবর শুনে গাফফার চৌধুরী, তার বন্ধু প্রখ্যাত নজরুল বিশেষজ্ঞ ড. রফিকুল ইসলাম (তখন ছাত্র), সাংবাদিক শফিক রেহমান (তখন ছাত্র) ছুটে যান হাসপাতালে। শহীদ রফিকের লাশ দেখামাত্রই গাফফার চৌধুরীর মনে স্বস্ফুর্তভাবে একটি কবিতার লাইন শোকাবেগে গুঞ্জরিত হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। শহীদের মৃতদেহের ছবি তোলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রকার আমানুর রহমান। হাসপাতালের পাশে মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাক-হোস্টেলের সামনে (এখন যেখানে শহীদ মিনার) তখনো ছাত্র জনতার ভিড়। এসময় গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয় তার এক বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের সাথে। তিনি গাফফার চৌধুরীকে বললেন- গাফফার মিছিলে ছিলেন? চৌধুরী বললেন-হ্যাঁ ছিলাম। গুলি শুরু হতেই মেডিক্যাল হোস্টেলের ভিতর আশ্রয় নেই। এখন হাসপাতালের বহিঃবিভাগের মেঝেতে ১ জন শহীদের মৃতদেহ দেখে এলাম। তাকে দেখে মনে হয়েছে, আমার আপন ভাই। মনেমনে একটি কবিতার লাইনও তৈরি হয়ে গেছে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ’।
কবিতার লাইনটি শুনেই আহমদ হোসেন গাফফার চৌধুরীর হাত চেপে ধরে বললেন- এই কবিতাটি এখনই লিখে ফেলুন। চৌধুরী বললেন- রাস্তায় দাড়িয়ে কি কবিতা লেখা যায়? হোস্টেলে ফিরে গিয়ে লিখব। আহমদ হোসেন বললেন, আপনি হেটে আরমানিটোলা পর্যন্ত যেতে যেতে কবিতাটি হারিয়ে যাবে। আপনি আমার সাইকেলটা নিন, তাড়াতাড়ি হোস্টেলে গিয়ে কবিতাটি লিখুন। গাফফার চৌধুরী তখন ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। কলেজ ভবন তখন পুরোনো ঢাকার সিদ্দিক বাজারে। সেখানে সরকারেরর রিকুইজিশন করা ভবনে ছাত্রাবাস। তিনি থাকেন আরমানিটোলার ‘বান্ধব কুটির’ নামে বিরাট ছাত্রাবাসে। সাইকেল চেপে সন্ধ্যার আগেই ‘বান্ধব কুটিরে’ ফিরে দেখতে পান গেটে নোটিস ঝুলছে। সরকারের নির্দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই রাতেই তাদের ছাত্রাবাস ছেড়ে যেতে হবে। গাফফার চৌধুরী কাপড়চোপড় গোছানোর জন্য দোতলায় নিজের কক্ষে গেলেন। তখন তার মনে হলো কবিতার কয়েকটি লাইন অন্তত লিখে রাখা দরকার। নাহলে কবিতাটি মন থেকে হারিয়ে যাবে। টেবিলে বসে কবিতাটির ৫-৬ লাইন লিখে ফেললেন, বাকিটা আর লেখা হলো না। এদিকে মনে দুশ্চিন্ত রাতে কোথায় থাকবেন?
ঢাকা কলেজের তখন আরেকটি ছাত্রাবাস ছিল বেগম বাজারে, নাম-নুরপুর ভিলা। হোস্টেল সুপরিন্টেডেন্ট ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক সাঈদুর রহমান। তারই ছেলে শফিক রেহমান। তিনি থাকেন হোস্টেলের গেস্ট হাউজের দোতলায়। ওই রাতে গাফফার চৌধুরী শফিক রেহমানের কাছে গিয়ে উঠলেন। সেখানেই কবিতাটির আরও কিছু অংশ লেখা হলো। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি শোক র্যালিতে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকের সঙ্গে গাফফার চৌধুরীও আহত হন, পায়ে মারাত্মক ব্যথা পান। তার সহপাঠী দাউদ খান মজলিশ তাকে নিয়ে যান বংশালে তার এক আত্মীয়ের বাসায়। সেই বাসার তেতলায় এক চিলে কোঠায় তিনি থাকতেন। সেখানে বসে একুশের কবিতাটি শেষ করার চেষ্টা করেন গাফফার চৌধুরী। কিন্তু পায়ের ব্যথার কারণে সবটা হয়ে ওঠেনি। ব্যথার কারণে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যালে। সেখানে এসে আহমদ হোসেন বললেন- গাফফার কবিতাটি লেখা শেষ হয়েছে? গাফফার চৌধুরী বললেন- অর্ধেকের মতো হয়েছে। আহমদ হোসেন হাত চেপে ধরে বললেন, আজই কবিতাটি শেষ করতে হবে। ভাষা আন্দোলন চালিয়ে রাখার জন্য তারা একটি ইস্তেহার প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। আহমদ হোসেন গাফফার চৌধুরীকে কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে বললেন-কবিতাটি এখনই শেষ করেন। অবশেষে গাফফার চৌধুরী কবিতাটির লেখা শেষ করলেন। পুরো কবিতাটি নিয়ে আহমদ হোসেন বের হয়ে গেলেন। একুশের গুলিবর্ষণের দু’চারদিনের মধ্যেই বের হলো রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের প্রথম ইশতেহার। দ্বিতীয় ইশতেহার বের করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। প্রথম ইশতেহারের অধিকাংশ লেখাই আবদুলাহ আল মুতী শরফুদ্দীনের। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ছাপা হয় গাফফার চৌধুরীর কবিতাটি। আহমদ হোসেনের চাপ না থাকলে কবিতাটি দ্রুত শেষ ও ইশতেহারে ছাপা হতো না। কর্মজীবনে আহমদ হোসেন ছিলেন বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির মহাসচিব। গাফফার চৌধুরীর সহপাঠী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ছোট ভাই আতিকুল ইসলাম ছিলেন তখনকার প্রখ্যাত তরুণ রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। একুশের শহীদদের স্মরণে গাওয়া যায় এমন একটি ভালো গানের সন্ধান তিনি করছিলেন। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া ইশতেহারে গাফফার চৌধুরীর কবিতাটি দেখে তার পছন্দ হয় এবং তিনি সেটি সুরকার ও গীতিকার আব্দুল লতিফের কাছে নিয়ে যান। আব্দুল লতিফ সাথে সাথে তাতে সুরারোপ করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজে শহীদ দিবস এবং ছাত্র ইউনিয়নের অভিষেক অনুষ্ঠানে আতিকুল ইসলাম সর্বপ্রথম আব্দুল লতিফের দেয়া সুরে এই গানটি গান। এই গান গাওয়ার অপরাধে আতিকুল ইসলামসহ আরও দশ ছাত্র (যারা অভিষেক অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন) কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। এক দুর্ঘটনায় আতিকুল ইসলামের অকাল মৃত্যু ঘটায় দেশ একজন প্রবল সম্ভানাময় কন্ঠশিল্পী থেকে বঞ্চিত হয়।
১৯৫৪ সালের গোড়ার দিকে সুরকার আলতাফ মাহমুদ (একাত্তরের শহীদ) করাচি থেকে ঢাকায় চলে আসেন। শুরুতেই বলেছি, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আব্দুল লতিফ ও আলতাফ মাহমুদ-তিনজনই বরিশাল জেলার মানুষ। গাফফার চৌধুরীর বাড়ি মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া, আব্দুল লতিফের সদর উপজেলার কড়াপুর এবং আলতাফ মাহমুদের মুলাদী উপজেলার পাতারচর। কিন্তু গাফফার চৌধুরী ও আলতাফ মাহমুদের মধ্যে আগে থেকে পরিচয় ছিল না, পরিচয়টি ঘটে তিনি ঢাকায় আসার পর। হঠাৎ তিনি একদিন গাফফার চৌধুরীকে বললেন, একুশের উপর লেখা তার গানটিতে তিনি নতুন করে সুর দিতে চান। গাফফার চৌধুরী বললেন, ‘আমার আপত্তি নেই। তবে আব্দুল লতিফ যেহেতু এই গানে প্রথম সুর দিয়েছেন, কাজেই তিনি কী বলেন দেখি।’ আলতাফ মাহমুদ বললেন, ‘চলুন না, লতিফ ভাইয়ের কাছে যাই’। আলতাফ মাহমুদকে আর যেতে হয়নি। ঢাকা রেডিওর অফিসে (তখন ছিল রেললাইনের পাশে খাজা নাজিমুদ্দিন রোডে) আব্দুল লতিফের সঙ্গে দেখা হয়। তাকে আলতাফ মাহমুদের ইচ্ছার কথা জানাতেই তিনি বললেন, ‘আলতাফ সুর দিতে চায়। খুব ভালো কথা। আমার আপত্তি নেই।’ একুশের গানটিতে আলতাফ মাহমুদ সুর দেওয়ার পরই গানটি একুশের প্রভাতফেরির গানের মর্যাদা পায়। গানটিতে মোট ৩০ টি পঙক্তি থাকলেও প্রভাতফেরির গান হিসেবে প্রথম ৬ পঙক্তি গাওয়া হয়।
একুশের গান সম্পর্কে একটি মজার কাহিনী হচ্ছে- দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফরাসী দার্শনিক আঁন্দ্রে মারলো ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির সুর শুনে মুগ্ধ হন এবং তার একটি রেকর্ড সাথে নিতে চান। বঙ্গবন্ধু সেকথা শুনে গাফফার চৌধুরীকে বলেন, ‘তুমি দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়ে এরকম একটি গান লেখো না কেন?’ গাফফার চৌধুরী বললেন, বঙ্গবন্ধু, আপনি ৭ই মার্চের ভাষণের মতো দেশবাসীর সামনে আরেকটি ভাষণ দেন না কেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দূর পাগল, তা কি আর সম্ভব?’ গাফফার চৌধুরী বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আমার পক্ষেও কি আরেকটি একুশের গান লেখা আর সম্ভব?’ একুশের এই গান আজ আর কেবল বাংলাদেশের গান নয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কোর এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রে গাওয়া হয় উলানিয়ার সেই দিনের কিশোর চান্দুর (আবদুল গাফফার চৌধুরীর ডাক নাম চান্দু মিয়া) লেখা এই গান।