পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল বাঙালি জাতি। পাকিস্তানিদের শাসন, শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিতে কোটি বাঙালির ত্রাতা হিসেবে আর্বিভূত হয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। রেডিওলজির ওপর উইলিয়াম রঞ্জনের আবিস্কারের পথ ধরে কুরি দম্পতি তাদের গবেষণা চালিয়ে যান এবং পলোনিয়াম ও রেডিয়ামের মৌল উদ্ভাবন করেন। তাদের উদ্ভাবন পদার্থবিদ্যায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে এই বিজ্ঞানী দম্পতির মহান অবদান চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে মানবতার কল্যাণে শান্তির স্বপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে “জুলিও কুরি” শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে। ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির স্বপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শান্তি পরিষদের এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়ান পিস এন্ড সিকিউরিটি কনফারেন্সের বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে “জুলিও কুরি” শান্তি পদক প্রদান করেন। এরপর তিনি বলেন “শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে”। এ সম্মান পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন “এ সম্মান কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক সমগ্র বাঙালী জাতির।” বঙ্গবন্ধুকে যখন জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান করা হয় তখনও বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়নি। হাতে গোনা কয়েকটি যাত্র দেশ সেই সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দরিদ্র দেশের সরকার প্রধানকে বৈশ্বিক শান্তি পদক প্রদান বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নিরলস প্রচেষ্টা, তাঁর কর্ম ও দর্শনের স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর শান্তির দর্শনের অন্যতম উপাদান ছিল-যুদ্ধ পরিহার করে যেকোনও বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান, সকল প্রকার বঞ্চনা ও শোষণমুক্তির মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ। বঙ্গবন্ধু সবসময় যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। তাই তিনি বলেছেন, “আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারির্দ্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’ কলকাতায় ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের লোককেই উদ্ধার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তিনি সারা জীবন ধর্মের অপব্যাখ্যা, ধর্মের নামে সহিংসতা, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন। অসাম্প্রদায়িকতা বলতে যে তিনি সব সম্প্রদায়ের সহ-অবস্থানের কথা বলেছেন শুধু তা-ই নয়, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার যে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে, সেই কথাও স্মরণ করিয়ে দেন এবং সে উদ্দেশ্যে তিনি সারা জীবন কাজ করেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও জনগণকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সতর্ক করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘দেখবেন, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসাম্প্রদায়িকতা তথা ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিকে কেবল সংবিধানেই ঠাঁই দেননি, বরং সাম্প্রদায়িকতা তথা ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগে যারা “জুলিও কুরি” শান্তি পদক লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহেরু, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুসহ যারা এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তাঁরা সবাই-ই বিভিন্ন দেশের নেতৃত্বে বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছিলেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তাঁদের অবদান ভুলে যাওয়ার মত নয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদের শান্তি পদক ছিল জাতির পিতার কর্ম ও প্রজ্ঞার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। বঙ্গবন্ধুর এই পুরস্কার আপামর বাঙালির জন্য এক বিরাট অর্জন। এ মহান অর্জনের সাথে জাতির পিতা পরিণত হন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে। কিন্তু এ প্রাপ্তি বা অর্জন দেশী-বিদেশী অনেকের কাছেই চোখের বালি বা ঈর্ষণীয় বিষয় ছিল। ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট জাতিসংঘ সদর দপ্তর আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দেন সংস্থাটির সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। এক বার্তায় বলেন, বৈশ্বিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বিশ্বনেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের প্রেক্ষিতে তাঁকে “বিশ্ববন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। এই বিষয়টিকে আমি যথার্থ এবং সময়োচিত বলে মনে করি। সঙ্গত কারণেই এ উপাধি নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক স্বীকৃতির দাবি রাখে বলেও আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। যার কারণে আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক, তাঁর কৃতিত্বকে স্মরণ করতে পারাও এক ধরণের বড় পাওয়া। আমরা যত তাঁর আদর্শ, কর্ম, কথা, অর্জন, অবদান ও চেতনা সঠিকভাবে পালন এবং ধারণ করতে পারবো, ততই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধা জানানো হবে বলে আমি মনে করি। আসুন, আমরা খারাপ চর্চা বাদ দিয়ে জাতির পিতার প্রকৃত আদর্শ আমাদের মনে ও হৃদয়ে ধারণ করে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করি। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১ এর লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি। আজকের দিনে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত শেখ হাসিনাও তাঁর পিতার মতো অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি সমৃদ্ধির পথে তাঁর অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাছাড়া তিনি দেশ-বিদেশের বিখ্যাত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও দেশী বিদেশী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মান সূচক উল্লেখযোগ্য ডিগ্রীসমূহ নিম্নরূপ: পার্বত্য চট্রগ্রামে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ইউনেস্কো প্রদত্ত ‘ফেলিক্স হোফে বোইনি শান্তি পুরস্কার, আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব প্রদত্ত ‘রাষ্ট্রপ্রধান পদক ১৯৯৬-১৯৯৭’, ভারত কর্তৃক ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পদক’, সর্বভারতীয় শান্তিসংঘ কর্তৃক ‘মাদার তেরেসা পদক’, বাংলদেশে তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও গণতন্ত্র প্রসারে অবদানের জন্য মহত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ফাউন্ডেশন (নরওয়ে) র্র্কর্তৃক ‘গান্ধী পদক’, ভারত সরকার প্রদত্ত ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক’, গণতন্ত্র সুসংহতকরণে প্রচেষ্টা ও নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখার জন্য ফ্রান্সের দোফিঁ বিশ¦িবদ্যালয় প্রদত্ত ‘স্বর্ণপদক’, শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক ‘এমডিজি অ্যাওয়ার্ড’, বিশ্ব মহিলা ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে অবদানের জন্য জাতিসংঘ ইকনোমিক কমিশন ফর আফ্রিকা, জাতিসংঘে এন্টিগুয়া-বাবুডার স্থায়ী মিশন, আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন ও সাউথ সাউথ নিউজ কর্তৃক ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড’, বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিশেষ অবদানের জন্য টঘঊঝঈঙ কর্তৃক ‘কালচারাল ডাইভারসিটি পদক’, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডক্টর অব লজ’, জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডক্টর অব লজ’, যুক্তরাজ্যের এবারেট ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডক্টর অব লিবারেল আর্টস’, শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অসাধারণ অবদানের জন্য অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ‘ডক্টর অব লজ’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের জন্য ‘ডক্টর অব লজ’, মানবাধিকার বিষয়ে অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিজপোর্ট কর্তৃক ‘ডক্টর অব হিউম্যান লেটারস’, আন্তর্জাতিক মানবিক উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ‘ডক্টরেট ডিগ্রি’, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি এবং উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডক্টর অব লিটারেচর ডিগ্রী’, এবং মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য ব্রিটিশ মিডিয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বলে আখ্যায়িত করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম, মানবতার কল্যাণ এবং শান্তির স্বপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্বশান্তি পরিষদ কর্তৃক “জুলিও কুরি” শান্তি পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। আমি আশা করি, আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধুর মত সাধারণ মানুষের মুক্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন কাজ করে বারংবার এমনই পুরস্কারে ভূষিত হবেন।
——————————
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়