যমুনা নদীর ওপর নির্মিত যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার অদূরে দেশের দীর্ঘতম যমুনা রেল সেতুর মূল অবকাঠামো সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণাধীন যমুনা রেলওয়ে সেতুর কাজ শেষ হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী বছর ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। উদ্বোধনের নানান প্রক্রিয়াও চলছে। সেতুটি নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয়ের থেকে ৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর উত্তর বঙ্গের গণমানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে একটি স্বতন্ত্র যমুনা রেলসেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে। এতে করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেলযাত্রীরা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের প্রহর গুনতে শুরু করেছে। উল্লেখ্য,বর্তমান যমুনা সেতু স্থাপনের সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ১৯৪৯সালে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর দশকের পর দশক ধরে জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে ১৯৯৪ সালে শুরু হয় ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন। বিএনপির শাসনামলে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেতুটি নির্মাণের প্রস্থর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তনের সুবাদে সেতুটির নাম পরিবর্তন করে ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’ নাম করণ করে ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির উপর দিয়ে রেল চলাচলের শুভ উদ্বোধন করেন। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পূর্ব পর্যন্ত এটিই দেশের দীর্ঘতম সেতু। সেতুটির উত্তর পার্শে সংযুক্ত ব্রডগেজ ও মিটারগেজ রেলসেতুও একইসাথে উদ্বোধন করা হয়। এতে করে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের ঢাকা হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গণমানুষ ঢাকা হয়ে পূর্বঞ্চলে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনে এক যুগন্তকারী সফলতা অর্জিত হয়। ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেয়। ২০১১ সালে ফাটলটি ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। এর পর থেকে অতি ধীর গতিতে এই সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রয়েছে। এমতাবস্থায় ১০১৬ সালে এই সেতুর উত্তর পার্শে ৩ শ’ মিটার অদূরে একটি স্বতন্ত্র রেলসেতু নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয় । সে বছর ডিসেম্বরে প্রকল্প পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে নকশানুপাতে সেতুটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। ২০২০ সালের ২৯ নবেম্বরেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি সেতুটির নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। এরপর ২০২১ সালের মার্চে রেলওয়ে সেতুটির পিলার নির্মাণে পাইলিং এর কাজ শুরু করা হয়। সেতুটির নির্মাণ কাজের ব্যয়ের বাজেট ও সময় বৃদ্ধির পর সবশেষে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা দাড়াঁয়। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন ধরা হয় ২৭.৬০ শতাংশ এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিয়েছে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, যা প্রকল্প ব্যয়ের ৭২.৪০ শতাংশ। এই রেলসেতুতে সমান্তরালভাবে ডুয়েলগেজ ও ডাবল ট্রাকসহ প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার রেল সেতুর দু-ধারে ০.০৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোস এম ব্যাংকমেন্ট এবং লুপ সাইডিংসহ রেললইন নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। প্রকল্পে রেলওয়ের পাশাপাশি গ্যাস সঞ্চালন লাইনও সংযোগ থাকছে এ সেতুতে। রেলওয়ে সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিডি)আল-ফাত্তাহ মো: মাসউদুর রহমান জানিয়েছেন, নির্মাণাধীন রেল সেতুর কাজ ইতোমধ্যে ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। আর বাকি ২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হলেই আশা করা যায়, চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে সেতুটি উদ্ভোধন করা সম্ভব হবে। সেই লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে রাত-দিন কাজ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে রেল সেতুর ওপর দিয়ে একাধিকবার ট্রায়াল ট্রেন চালিয়ে রেল সেতুর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়েছে। প্রকল্প সূত্রে জানাগেছে, সেতুটিতে ট্রেন চলাচল শুরু হলে দ্রুতগতির ট্রেনগুলো ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে। এছাড়া মেইল ট্রেনসহ অন্যান্য সাধারণ যাত্রীবাহী ও ভারী ওয়াগন মালামাল পরিবহনযোগ্য দৈনিক অন্তত ৮৮ টি ট্রেন চলাচল করতে পারবে। বগুড়া টু সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বর্তমানে রেলওয়েতে দেশের পশ্চিমাঞ্চল সান্তাহার, নাটোর ও পাবনার ঈশ্বর্দী হয়ে বগুড়া থেকে ঢাকা যেতে অতিরিক্ত ১২০ কিলোমিটার অতিরিক্ত রেলপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। এতে উত্রাঞ্চলের রেলযাত্রীদের ২-৩ ঘন্টা অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হয়। সেই সেোথ অতিরিক্ত ট্রেন ভাড়া নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। সিরাজগঞ্জ-বগুড়া সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ স্থাপন হলে মাত্র ৩-৪ ঘন্টার ব্যবধানেই নিরাপদে স্বচ্ছন্দে ঢাকা যাতায়াত সম্ভব হবে। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। বাংলাদেশ সরকার ও ভারতের ঋণের অর্থায়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এত ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ রাখ টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি ৫৯ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ দেবার কথা আছে ভারত। শুরুতে প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ৩০ জুনে শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু সেটা অজ্ঞাত কারণে স্থবির হয়ে পড়ে। এরপর ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতীয় কতৃপক্ষ পরামর্শক নিয়োগ দেবার পর,তারা ২০২৩ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ডুয়েল গেজের দুটি রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। একটি হলো বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটার, অপরটি বগুড়ার কাহালু স্টেশন থেকে রাণীরহাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার রেলপথ। বিশেষত সান্তাহারের দিক থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে সান্তাহার হয়ে দিনাজপুরের পার্বতীপুর গামী ট্রেনগুলো যাতে বগুড়া স্টেশনকে এড়িয়ে সরাসরি চরাচল করতে পারে। সেজন্য কাহালু-রাণীরহাট রেলপথ নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দুটি রেলপথ মিলিত হওয়ার কারণে বগুড়া শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে রাণীরহাটে একটি জংশন নির্মাণ করা হবে অপর জংশনটি নির্মাণ হবে সিরাজগঞ্জে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রের হিসেব অনুযায়ী গত দেড় দশকে গত ১৫ বছরে রেলে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা আর লোকসান হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে রেলওয়ের আয়ের চেয়ে ব্যয় আড়াই গুণেরও বেশি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম টু কক্সবাজার রেল লাইন সম্প্রসারিত হয়েছে। এবার সিরাজগঞ্জ টু বগুড়া রেললাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে এ রুটে রেল চলাচল শুরু হলে এবং রেলের চলমান সিন্ডিকেট ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে রেলের লোকসান তো দূরের কথা লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যমুনা রেলওয়ে সেতুটি চালু হলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেলযাত্রীদের জন্য নিরাপদ ও দ্রুত গতির রেল পরিষেবা নিশ্চিত হবে।