দেশে শিল্প-কারখানা কয়েক গুণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। উন্নয়ন ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির মধ্যেই অনিরাপদ কর্মপরিবেশে নিয়মিত অকালমৃত্যু ঘটছে শ্রমিকদের। নির্মাণ, শিল্প, কৃষি, ইস্পাত, জাহাজভাঙা, পাথরভাঙা কোনো খাতেই শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন নেই। কোন কোন খাতে, কী কারণে, শ্রমিকেরা নিয়মিত হতাহত হচ্ছেন, পঙ্গুত্ববরণ করছেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও নেই। নেই যথাযথ চিকিৎসা, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও কার্যকর প্রতিরোধের আয়োজন। বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) সকাল সোয়া ৮টার দিকে গাজীপুর এর শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পূর্বখণ্ড এলাকায় বহুতল ভবনের কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে তিন শ্রমিক নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তবে হতাহতেদের নাম পরিচয় জানা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস বলছে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে কেওয়া পূর্বখণ্ড এলাকার স্কাইনিস পাওয়ার কোম্পানি নামে বহুতল ভবনে কাজ করছিল শ্রমিকরা। এসময় অসাবধানতাবশত নির্মাণাধীন ভবনের রডের সঙ্গে পাশের বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শ হলে দীর্ঘ সময় আগুন জ্বলতে থাকে। এতে কয়েকজন পুড়ে যায়। গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ্ আল আরেফিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দেখা যায়, রাজধানীসহ দেশজুড়েই গড়ে উঠছে বিপুলসংখ্যক বহুতল ভবন। কিন্তু এসব ভবন নির্মানে নির্মাণ শ্রমিকদের দুর্ঘটনা এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়তই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা। এমনকি ওই দুর্ঘটনা থেকে পথচারীরাও রেহাই পাচ্ছে না। পাশাপাশি কেউ কেউ মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছে। মূলত যথাযথ তদারকির অভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সূত্র আরও জানায়, গত ৬ বছরে শুধু রাজধানীতে নির্মাণ খাতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৬২০ শ্রমিক নিহত হয়েছে। ওই সময় আহত হয়েছে ৫৭৮ শ্রমিক। তাদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছে। রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ লাখের মতো নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। ফলে বহুতল ভবনে নির্মাণ শ্রমিকরা অরক্ষিত অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের কোন ধরনের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না। ফলে নির্মাণ শ্রমিকদের পাশাপাশি আশপাশের মানুষ ও ভবনের নিচের পথচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। এক কথায় নির্মাণ শ্রমিকরা আইনি সুরক্ষা পাচ্ছে না। মূলত মালিকপক্ষের অবহেলার কারণে নির্মাণ খাতে শ্রমিক মৃত্যু ও হতাহতের সারি দিন দিন দীর্ঘতর হচ্ছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের জলঢাকা শাখার নির্বাহী সভাপতি মাহাদী হাসান মানিক জানান, জাতীয় বিল্ডিং কোডে কর্মকালীন একজন শ্রমীকের কী কী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। আর বিষয়টি তদারক করার দায়িত্ব যাদের, তারাও উদাসীন। ফলে নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকায় প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। কর্মক্ষেত্রে কোনো শ্রমিক মৃত্যুবরণ করলে আগে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান ছিল। তবে ২০১৮ সালের শ্রমিক আইন মৃত্যুর কারণে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দ্বিগুণ করে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। আহত হয়ে স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে ক্ষতিপূরণের টাকাও দ্বিগুণ করা হয়েছে। আগে ওই ক্ষতিপূরণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। এখন তা বাড়িয়ে আড়াই লাখ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী কাজের সময় কাজের শ্রমিকের মাথায় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। তাছাড়া যারা কংক্রিটের কাজে যুক্ত তাদের হাতে গ্লাভস ও চোখের জন্য ক্ষতিকর কাজে শ্রমিকদের চশমা ব্যবহার পরিধান করতে হবে। ওয়েল্ডার ও গ্যাস কাটার ব্যবহারের সময় রক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন গ্লাভস, নিরাপত্তা বুট, এ্যাপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে ভবনের ওপরে কাজ করার সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তায় বেল্ট ব্যবহারও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু তার কোনটিই বাস্তবে দেখা যায় না। ভবন মালিকপক্ষের ওসব নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি নিশ্চিত করার দায়িত্ব। যদিও কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট আইন রয়েছে। বর্তমানে আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে নিরাপদ হচ্ছে না নির্মাণ খাত। তাতে দুর্ঘটনায় মৃত্যু মিছিল বাড়ছে। আর পার পেয়ে যাচ্ছে মালিক পক্ষ। বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির ১৫টি জাতীয় দৈনিক ও ১১টি আঞ্চলিক দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে তৈরি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মস্থলে বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা ৭১২, যা ২০২১ সালে ছিল ৫৩৮ ও ২০২০ সালে ৪৩৩। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নির্মাণ শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ নুরুল হক জানান, নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র কখনোই নিরাপদ ছিল না। আইনে যা যা বলা আছে বর্তমানে তার মাত্র ১০ শতাংশ বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটাকে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ যাতে নিশ্চিত করা হয় তার দাবি জানাচ্ছি। আইন যদি কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে আশা করা যায় কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের মৃত্যু শূন্যে নেমে আসবে। এজন্য শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র তদারকির দায়িত্ব থাকা প্রতিষ্ঠান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে।
ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) :
এর সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘শ্রম আইন মেনে চললে নির্মাণ খাতে প্রতিবছর এত শ্রমিকের মৃত্যু হতো না। মালিক-ঠিকাদার একত্র হয়ে এটা করার কথা থাকলেও করে না। এ ছাড়া সরকারের কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করাসহ স্বাস্থ্যসম্মতভাবে থাকার ব্যবস্থাগুলো দেখার কথা থাকলেও কখনো তারা করে না। শ্রম আইনও বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ না করায় এত শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে। শ্রম আইনে কর্মক্ষেত্রে মারা গেলে দুই লাখ এবং স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে গেলে আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেটি অনেক ক্ষেত্রে মানছে না ভবন মালিকপক্ষ।’ শ্রমিক অধিকার সংস্থাগুলোর মতে, দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে কিংবা পরে হতাহত শ্রমিকদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ থাকে না। সবাই তখন অচেনা হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত নির্মাণ শ্রমিক উঁচু ইমারত থেকে ঝুপ ঝুপ করে পড়ে মারা যাচ্ছেন। অনেক সময় কেউ তাদের নাম বলতে পারে না! কেউ জানায়না ইমারতের মালিকের নাম। কোথাও সে কথা ছাপা হয় না। কেউ জানে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা ডেভেলপারের পরিচয়ও। যার ফলে শ্রমিকের মৃত্যুর পর সবাই যেন উদাসীন হয়ে যায়। অথচ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষকে আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বিভিন্ন কনভেনশন/ ঘোষণা/ রিকমন্ডেশন/দলিলের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।