দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন বছর আগে থেকেই কিশোরী শামসুন নাহার ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হন। সেটা ছিল ১৯৬৯ সাল। মেয়েদের লেখাপড়া শিক্ষায় সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তখন তিনি গাজীপুরের জয়দেবপুর গার্লস স্কুলের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী, ছিলেন সমাজ সচেতন ও প্রতিবাদী। এই সময়ে তিনি পরিবার পরিজনের সাথে জয়দেবপুরের পশ্চিম ভুরুলিয়ায় পিত্রালয়ে বস বাস করতেন।
১৯৭৩ সালে জয়দেবপুর গার্লস স্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করেন। পরের বছর ১৯৭৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তঁার স্বামী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ ভঁূইয়ার বাড়ি টঙ্গীর নোয়াগঁাও এলাকায়। কাজেই সেখানে থেকেই সংসার জীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিবেশে জীবনের চাকা ঘুরতে থাকে। এবং ১৯৭৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।
কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির ধরন একটু ভিন্ন। এই দলের কর্মীদের সৎ ও নির্লোভ হয়ে কাজ করার জন্য হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা হয়। এই শিক্ষা শামসুন নাহারকে সারাজীবন নির্লোভ থেকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকার প্রেরণা জুগায়। অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময় ধরে রাজনীতি করছেন তিনি। এই সময়ে তার কর্মকান্ডের ফিরিস্তি বেশ লম্বা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এর মধ্যে জাপান লেবার ফাউন্ডেশন (জিলাফ), আই.সিএফ.টি.ইউ-বি.সি (ওঈঋঞট-ইঈ), ওখঙ, ইওখঝ, ককাস উল্লেখযোগ্য।
বিশেষ করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করতে এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের পক্ষে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন শামসুন নাহার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২৯ মে অনুষ্ঠিত মহিলা শ্রমিক লীগের ১ম সম্মেলনের মাধ্যমে মহিলা শ্রমিকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুন নাহার। এরপর ২০১৯ সালে মহিলা শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে তঁাকে কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ বছরই বাংলাদেশ একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য-৩১৩, মহিলা আসন-১৩ নির্বাচিত হন। এছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
সংসদ সদস্য হিসেবে ২০১৮-১৯ অর্থ বছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছর পর্যন্ত তঁার নামে বরাদ্দকৃত টিআর, কাবিখা, কাবিটা, টি অর সোলার, নন সোলার, ঐচ্ছিক, ক্রীড়া সামগ্রী সহ যাবতীয় সামগ্রী শত শত প্রকপ্লের মাধ্যমে সঠিকভাবে বিতরণের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এ কাজে সব সময় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে রেখেছেন নিজেকে। এসব বিতরণের সময় আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতায় খোলামেলাভাবে সবাইকে সব তথ্য অবগত করতেন। কত বরাদ্দ পেয়েছেন, কাকে বা কোন প্রতিষ্ঠানকে কি কাজের জন্য কত বরাদ্দ দেওয়া হলো এসব তথ্য প্রকাশ করতেন। সংবাদ কর্মীদেরও এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করতেন। যাতে তঁার কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়। আগে পরে এবং একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদকালে তঁার বিরুদ্ধে কখনও কোন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজন প্রীতির অভিযোগ উঠেনি। সবসময় যেমন সাদামাটা আটপৌড়ে জীবনযাপন করতেনÑ সংসদ সদস্য হবার পরও তেমনি ভাবেই চলেছেন। ক্ষমতার দাপট দেখানো কিংবা এর অপব্যবহার করতে দেখা যায়নি। সংসদ সদস্য হবার পরও আগের মতোই সাদামাটা আটপৌঢ়ে জীবনযাপন করেছেন তিনি। যা তঁাকে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে। মানুষের সেবায় সবসময় কর্মব্যস্ত সময় কটাতে দেখা যায় এই রাজনীতিক ও নির্লোভ, সৎ নারী নেত্রীকে।
১৯৭৬ সালে টঙ্গী কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় পর্টির নির্দেশে নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে টঙ্গীস্থ এবি বিস্কুট কারখানায় একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগদান করেন শামসুন নাহার। এবং ঐ বিস্কুট কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। এসময় থেকেই তিনি সরাসরি ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হন এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তঁার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়। ১৯৭৬ সালের মার্চে যেদিন বাসায় ফিরেন ঠিক সেদিনই তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘ একবছর তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন।
আব্দুর রশীদ ভঁূইয়া ইঞগঈ আওতাধীন মেঘনা টেক্সটাইলের ঈইঅ নেতা ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থায়ই তিনি চাকুরীচ্যুত হন। ’৭৫ পরবর্তী জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের সময় শামসুন নাহার ও তঁার স্বামী নানাভাবে নির্যাতন ও হয়রানীর স্বীকার হন।
১৯৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রথমে ৮দল ও পরে ১৫ দলের সাথে নিজ জেলার সকল প্রোগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন শামসুন নাহার। ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ.ক.ম মোজাম্মেল হকের (বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী) পক্ষে নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৮ সালে নারী শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে ডড়ৎষফ ঋবফবৎধঃরড়হ ড়ভ ঞৎধফব টহরড়হ (ডঋঞট) এর সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৭৯ সালে কারখানায় ইউনিয়ন করার অপরাধে তঁাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ১৯৮৬ সালে শ্রমজীবী মানুষের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য টঙ্গী রেলওয়ে শিশু নিকেতন নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যা অদ্যাবধি সুনামের সাথে চলছে।
১৯৮৭ সালে টঙ্গী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের (সাধারণ আসনে) সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে কমিশনার নির্বাচিত হন শামসুন নাহার। এবছর তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে সরাসরি ভোটে কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালে শামসুন নাহার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস (ইওখঝ) এর সদস্য এবং বর্তমানে সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ইওখঝ -এর একজন (শ্রম আইন বিষয়ক) নিয়মিত প্রশিক্ষক হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৯৭ সালে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে শেখ হাসিনার আহ্বানে ও তঁারই সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় নুহ আলম লেলিন, সাবেক এমপি শামসুদ্দোহা, মুকুল চৌধুরী, আনোয়ার জাহিদ (বরিশাল), আবুল কালাম আজাদ (ট্যানারী), বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ ভঁূইয়া (গাজীপুর), বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ (গাজীপুর), সাবেক এমপি (চট্রগ্রাম) মরহুম ইউসুফ আলী, শ্রমিক নেতা (খুলনা) মোতাহার হোসেন ও শামসুন নাহার সহ কয়েক হাজার নেতা-কর্মী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৯৮ সালে জাতীয় শ্রমিকলীগ টঙ্গী আঞ্চলিক কমিটির সদস্য হন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভোট ও ভাতের দাবীতে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি এবং তঁার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল ঘোষিত স্বৈরাচার বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
২০০৪ সালের ২ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জোট সরকার কর্তৃক বরিশালে সংখ্যালঘু নারীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় যোগদান শেষে বাড়ি ফেরার পথে তঁাকে সহ প্রায় ৫শ’ নারী শ্রমিককে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে তঁাকে সহ কয়েকজনকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
২০১৯ সালে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় বেন্ডু ফেশান লিঃ এর শ্রমিকরা তাদের বকেয়া মজুরীর দাবীতে রাজপথ অবরোধ করে। তখন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সাথে কথা বলে তাদের শান্ত করেন। প্রশাসনের সহযোগীতায় শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা ৭ কোটি টাকা পরিশোধ করার মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন করেন।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফ্ট গামেন্টস এর শ্রমিকদের কয়েক মাসের মজুরী বকেয়া থাকায় শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তা অবরোধ করে। তারা প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় ঐ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ঐদিনই রাতে গাজীপুরে ফিরিয়ে এনে পরবর্তীতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় তাদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করেন।
দীর্ঘ সময় খধনড়ঁৎ খধ িসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তিনি। শিক্ষা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের জন্য বিভিন্ন সময় রাশিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, জাপান, ইটালি, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভারত সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেন। গার্মেন্টস সেক্টরে ২০১০ সালে ও ২০১৮ সালে এবং চাতাল সেক্টরে ২০১২ সালে মজুরী বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে সুপারিশ করে অর্থ প্রাপ্তিতে সহায়তা করেন। শ্রমিকদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে সহায়তা প্রদানেও অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। স্কুল কলেজে ভর্তির বিষয়ে গরীব মেধাবীদের সহায়তা করেন। তঁার স্বামী মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ ভূঁইয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পক্ষ থেকে করোনা কালীন সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন। প্রতি রোজার সময় অসহায় মানুষের মাঝে ঈদ উপহার হিসেবে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন।
এমপি শামসুন নাহার এর দীর্ঘদিনের চেষ্টা এবং সরকারি সহযোগীতায় গাজীপুরে লেবার কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার সুফল শ্রমজীবী মানুষ পাচ্ছে।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ১/১১ এর সময় এবং দলীয় সকল কর্মসূচি তথা আন্দোলন সংগ্রাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা পালন করতে গিয়ে একাধিকবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি এবং জেলে নিক্ষিপ্ত হন।
গাজীপুরে বসবাস করে সারাজীবন রাজনীতি করলেও তাকে কখনও দলে বিভেদ সৃষ্টি হয় এমন কোনও কর্মকান্ডে জড়িত হতে দেখা যায়নি। বরং বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারী দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করাই ছিল তার মূল দর্শন।
সর্বোপরি একেবারে সাধারণ জীবনযাপন করে সততার সাথে মানব সেবায় জীবন উৎসর্গ করতে দেখা যায় শামসুন নাহারকে। তঁার এইসব গুণের মূল্যায়ন করেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ফলে তিনি একাদশ সংসদের সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেন। তঁার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বেশির ভাগ মানুষের চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে। কারণ নিভর্ৃর্তচারী এক সমাজ সেবী হিসেবে তিনি প্রচার-প্রচারণার চেয়েও চুপচাপ কাজ করে যাওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কারণে তঁার মতো একজন সৎ, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক অভিজ্ঞ রাজনীতিককে দেশ ও মানুষের সার্বিক কল্যাণে আরও বেশি বেশি কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। তঁার অসাধারণ কর্মগুণের যথাযথ মূল্যায়ন করার মধ্যে দিয়েই তা সুসম্পন্ন হতে পরে।