প্রকৃতিতে ক্যালেন্ডারের পাতায় বাজছে শীতের বিদায়ী ঘণ্টা। কিছুদিনের মধ্যে বেলা ফুরাবে অতিথি পাখিদের, ফিরবে নিজ মাতৃভূমিতে। শীতের বিদায়ের সাথে সাথে বসন্তের আগমনে ফাল্গুনের হাওয়া চারিদিক মুখরিত। সময়ের পালাবদলে প্রকৃতির এই খেলায় ঋতুরাজ বসন্তে প্রকৃতি সেজেছে নতুন রূপে। আগুন ঝরা ফাল্গুনের আহ্বানে শিমুল গাছে ফুটেছে পলাশ। গ্রামের মেটো পথের দূর সীমানা থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহু কুহু কলতান। নানা ফুলের সঙ্গে সূর ছড়াচ্ছে আমের গাছের মুকুলও। সোনালি হলুদ রঙের আমের মুকুলের মনকাড়া ঘ্রাণ। মুকুলের সেই সুমিষ্ট সুবাস আলোকিত করে তুলছে মানুষের হৃদয়।মৌমাছির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে গুনগুন শব্দে। ছোট পাখিরাও মুকুলে বসেছে মনের আনন্দে।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে আম বাগানে। দৃশ্যটি যে কাউকেই কাছে টানবে। গাছের শাখার পর শাখায় ফুলগুলো চারিদিক যেন ফাল্গুনের রূপের ঝলসানোময় উচ্ছ্বাসের জানান দিচ্ছে। ঋতু বৈচিত্র্যের মধুর মাস আগমন এই বসন্তে। সবুজ প্রকৃতির আমেজ অনেকটা এখন আবেগের। বসন্তের ফাল্গুন আর আমের মুকুল তাই যেন একই সূত্রে গাঁথা। বছরের এই নির্দিষ্ট সময় জুড়ে প্রায় চারিদিকে শ্রেণী পেশার মানুষেরও দৃষ্টিও থাকে চির সবুজ আম গাছের মগডালে। আম গাছের সদয় মুকুল ফোটার এ দৃশ্য ছেঁয়ে গেছে রাজাপুর উপজেলা সদরসহ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। উপজেলার সব এলাকাতেই এখন কম-বেশি রয়েছে আমের বাগান। দুরন্ত শৈশবে কাঁচা-পাকা আম পাড়ার আনন্দ অনেকেরই স্মৃতিতে চির অমর। তাছাড়া বর্তমানে আম বাংলাদেশের প্রধান চাষযোগ্য অর্থকরী ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম।
‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা / ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে / মামার বাড়ে যাই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে / আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের মধুর রসে / রঙিন করি মুখ…।’
পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের ‘মামার বাড়ি’ কবিতার পংক্তিগুলো বাস্তব রূপ পেতে বাকি রয়েছে আর মাত্র কয়েক মাস।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কৈবর্তখালী গ্রামের ফারুক সিকদারের আম বাগানের সারি সারি গাছে শোভা পাচ্ছে কেবলই মুকুল। তবে সুখের ঘ্রাণ বইতে শুরু করেছে। গাছে গাছে ফুটছে আমের মুকুল। এ যেন হলুদ আর সবুজের মহামিলন। মুকুলে ছেয়ে আছে গাছের প্রতিটি ডালপালা। চারদিকে ছড়াচ্ছে সেই মুকুলের সুবাসিত পাগল করা ঘ্রাণ। যে গন্ধ মানুষের মনকে বিমোহিত করে। পাশাপাশি মধুমাসের আগমনী বার্তা শোনাচ্ছে আমের মুকুল। তবে আমের ফলন নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন বাগান মালিকরা। বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং স্বাদ-গন্ধে আম একটি অতুলনীয় ফল। বিশেষ করে শীতের শেষে যখন আমের মুকুল আসে, আর সেই মুকুল থেকে যখন ছোট ছোট আম বের হয়, সেই আম পাড়তে গিয়ে মায়ের বকুনী বৃদ্ধ বয়সে ও অনেকের কাছে স্মৃতিপটের চেনা ইতিকথা। উপজেলার অনেক স্থানে এবার আগাম আমের মুকুল লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
উপজেলার কৈবর্তখালী গ্রামের আম চাষি ফারুক সিকদার জানান, এ বছরে আবহাওয়া আমের মুকুলের জন্য বেশ অনুকূলে। টানা শীত ও কুয়াশার দাপট কেটে আবহাওয়া আমের মুকুলের অনুকূলে এসেছে। গতবারের মতো এ মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়ার তেমন বিপর্যয়ও ঘটেনি। এরই মধ্যে আমের গাছে গাছে মুকুল ব্যাপকভাবে এসেছে। আশা করছে ভরা ফাল্গুনে এবার উপজেলা সদরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে আম গাছে ব্যাপক আম ধরবে। মুকুল আসার পর থেকেই তারা গাছের প্রাথমিক পরিচর্যা শুরু করেছেন। মুকুল রোগ বালাইয়ের আক্রমন থেকে রক্ষা করতে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ স্প্রে করছেন তারা।শীলা বৃষ্টি হলে আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। আবহাওয়া ও প্রকৃতির দুর্ভোগ নিয়েই যথেষ্ট শঙ্কায় রয়েছে এই আম চাষি। তবে গাছে গাছে আমের যেভাবে মুকুল এসেছে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার আমের ব্যাম্পার ফলন হবে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে রাজাপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মোসা শাহিদা শারমিন আফরোজা জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার আম গাছে খুব একটা কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হবে না। তবে ছত্রাক জনিত রোগেও আমের মুকুল ফুল গুটি আক্রান্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাক নাশক ২ গ্রাম অথবা এমাডোক্লোরিড গ্রুপের দানাদার প্রতি লিটার ২ গ্রাম তরল .২৫ মিলি মিটার ও সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি লিটার মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। আবার মুকুল গুটিতে রূপান্তরিত হলে একই মাত্রায় ২ বার স্প্রে করতে হবে। এতে ছত্রাক জাতীয় রোগ থেকে আমের মুকুলগুলো রক্ষা পাবে সেই সাথে উপজেলায় বাম্পার আমের ফলন হবে বলে তিনি জানান।