সিলেটের সীমান্তবর্তী লালাখাল জিরো পয়েন্ট এলাকায় একটি অস্থায়ী দোকানে চা-বিস্কুট বিক্রি করে নবম শ্রেণির ছাত্র আগর বারাইক। তার বাবা হরি বাহাদুর স্থানীয় একটি চা-বাগানে কাজ করেন। পর্যটন মৌসুমে বাবা-ছেলে মিলে এ দোকান চালান। আগর বারাইক জানান, ছয়-সাত বছর ধরে এ এলাকায় অনেক পর্যটক আসছেন। ফলে তাঁরাও নিয়মিত কাজের বাইরে পর্যটন ঘিরে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করেন। এ সময়ে দৈনিক ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয় তাঁদের। সিলেটের সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার সারী নদী ও সংলগ্ন লালাখাল এখন দেশের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা। ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে এ নদীর উৎপত্তি। এ নদীর পানি স্বচ্ছ ও নীল হওয়ায় অনেকে একে ‘নীলনদ’ বলেও ডাকেন। গত শনিবার লালাখালে গিয়ে আগর বরাইকের সঙ্গে কথা হয়। জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ও নিজপাট ইউনিয়ন পরিষদের এ এলাকায় প্রায় সাত হাজার মানুষের বাস। মূলত বালু, পাথর ও কয়লা আহরণ এখানকার মানুষের প্রধান পেশা। একাধিক চা-বাগানে হাজারখানেক শ্রমিক কাজ করেন। বাণিজ্যিকভাবে সবজি চাষের বেশ কিছু প্রকল্পও রয়েছে। আর লালাখালকেন্দ্রিক পর্যটকের আনাগোনা বাড়ছে কয়েক বছর ধরে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পর্যটনকেন্দ্রিক জীবিকাও। পর্যটকদের জন্য এখানে আধুনিক মানের একটি রিসোর্টও গড়ে উঠেছে। লালাখালের পানি থেকে ছোট পাথর তোলেন অনেকে। স্থানীয় লোকজন এ কাজকে বলেন, সিঙ্গেল পাথর ওঠানো। এতে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয় তাঁদের। তাঁদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা এসব পাথর কিনে সারা দেশে বিক্রি করেন। কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি জানালেন, সাধারণত এসব পাথর ভারতের সীমান্তসংলগ্ন জিরো পয়েন্ট ও নো ম্যানস ল্যান্ড এলাকায় বেশি পাওয়া যায়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে তাঁদের বাধা দেন। যদিও কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকেই পাথর আহরণ করেন। নদী থেকে কয়লা তোলার কাজও চলে সেখানে। আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে সারী নদী থেকে কয়লা তুলতে দেখা গেল। তাঁর দলে আছেন আরও তিনজন। আনোয়ার জানান, ভারত থেকে এসব কয়লা নদীর পানির সঙ্গে ভেসে বালুর নিচে জমা হয়। মেশিনের সাহায্যে বালু তুলে কয়লার টুকরা আলাদা করা হয়। যদিও কয়লাগুলো নিম্নমানের। আনোয়ার আরও জানান, সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত তাঁরা কয়লা তোলার কাজ করেন। এ সময় কমপক্ষে আট বস্তা কয়লা তুলতে পারেন তাঁরা। প্রতি বস্তা কয়লা ৪০০ টাকা দরে ইটভাটায় বিক্রি করেন তাঁরা। এতে জনপ্রতি দৈনিক আয় হয় ৮০০ টাকা। আর বর্ষাকালে দৈনিক গড়ে ২০ বস্তা করেও কয়লা তুলতে পারেন তাঁরা। পর্যটন মৌসুমে এখানে নৌকার চাহিদা বাড়ে। লালাখাল নৌকা মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হোসেন জানান, লালাখাল এলাকায় মোট ৭৫টি নৌকা আছে। পর্যটন মৌসুমের ছুটির দিনে দৈনিক ৭০০-৮০০ টাকা আয় হয় তাঁদের। এ ছাড়া অন্য দিন ৩০০-৪০০ টাকা করে আয় করেন তাঁরা। এ ছাড়া সারী নদীতে হঠাৎ পানির প্রবাহ বেড়ে গেলে অনেক মাছের দেখা মেলে। তখন স্থানীয় লোকজন মাছ ধরেন। এ নদীতে বোয়াল, রুই, কাতলা, ট্যাংরাসহ বেশ কিছু প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। অবশ্য পাহাড়ঘেরা মনোরম এ এলাকার বাসিন্দাদের আছে বেশ কিছু অসুবিধাও। এর মধ্যে অন্যতম ভাঙা সড়ক ও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সংকট। লালাখালে ঘুরতে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, এখানে আসার রাস্তা ভালো নয়। সে জন্য এখানে পর্যটকেরা সিলেটের অন্যান্য স্থানের তুলনায় এখানে কম আসেন। পাশাপাশি পর্যটন স্পট হিসেবে এখানে ভালো মানের রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠেনি। পর্যটকদের জন্য নেই ভালো বসার জায়গাও। স্থানীয় বাসিন্দা রুহেল আহমেদ জানান, তাঁদের এখানে খাওয়ার পানির অনেক সমস্যা আছে। টিউবওয়েলের সংখ্যাও অনেক কম। অনেককেই এক-দেড় কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয়। এ জন্য নদীর পানি ফুটিয়ে পান করেন তাঁরা। এ ছাড়া বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ধরে রাখেন তাঁরা। এ বিষয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. কামাল আহমদ বলেন, পাহাড়ি এলাকা হওয়ার কারণে সাধারণ টিউবওয়েল এখানে বসানো যায় না। এর পরিবর্তে বিশেষভাবে কুয়া স্থাপন করতে হয়। তবে এতে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। তিনি আরও বলেন, হাওর এলাকায় টিউবওয়েলের অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও লালাখাল পাহাড়ি এলাকায় তেমন প্রকল্প নেওয়া হয়নি। ফলে খাওয়ার পানির উৎসও বাড়ানো যায়নি।
নবচেতনা /এমএআর