নদীর সঙ্গে মানুষের মিলন নিরবধি। সভ্যতার শুরু থেকে এ মিলন অদ্যাবধি শাশ্বত। নদীর স্নিগ্ধতায় পর্যটকদের প্রাণ ছুঁয়ে যায়, নদীর মিতালি পর্যটকদের মায়াবী সুরে বার বার ডাকে। তাই যদি এমন হতো, নদী পর্যটনের সাথে কৃষি পর্যটনের সমন্বয় ঘটতো তাহলে প্রকৃতির একদম নিগুঢ় স্বাদ আস্বাদন করা যেত। ঢাকা শহর হতে প্রায় ১১০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত সিরাজগঞ্জ জেলায় রয়েছে বহু দৃষ্টিনন্দন স্থান। যমুনা নদী বিধৌত এ জেলা বাংলাদেশের ভৌগলিক, সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনীতিক, শিল্প, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে যেমন বৈচিত্র্যময় অবদান রেখেছ। তেমনিভাবে আমাদের প্রাণপ্রিয় সিরাজগঞ্জ হতে পারে কৃষি ও নদী পর্যটনের অপার এক সম্ভাবনার যায়গা। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত এ জেলা দিয়ে দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ যাতায়াত করে থাকে। পর্যটন শিল্প বিকাশে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিরাজগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু, যমুনা রেল সেতু, বাঘাবাড়ি নদী বন্দর, হার্ড পয়েন্ট, ছয় আনি পাড়া দুই গম্বুজ মসজিদ, নবরত্ন মন্দির, জয়সাগর দিঘী, ইলিয়ট ব্রিজ, চলন বিল, মখদুম শাহের মাজার, বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাধ, ইকো পার্ক, শেখ রাসেল শিশু পার্ক, কাজীপুরের মেঘাই ঘাট, এনায়েতপুরের খাজা ইউনুস আলী হসপিটাল, শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর বাড়ী, দর্শনীয় এসব স্থানগুলোর বেশীরভাগই গড়ে উঠেছে যমুনা নদীকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে সাথে যমুনা নদী প্রবহমানতায় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। বর্ষার নদী, শীতের নদী, গ্রীষ্মের নদী যেন একই অঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। আবার সকালের সূর্যাস্তের নদী, দুপুরে প্রখর রোদে নদী, সন্ধ্যার সূর্যাস্তের আবহে নদীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতের নদী যেন অবর্ণনীয় নৈসর্গিক আবহ। বৈচিত্র্যময় আমাদের নদীর সৌন্দর্য। শুষ্ক মৌসুমে যমুনার স্ব”ছ পানি, দৃষ্টিনন্দন যমুনার চর, নদীর তাজা মাছের স্বাদ আহরণ কিংবা নিজ হাতেই নদীতে মাছ ধরতে নেমে পরা, সদ্য জেগে উঠা চরে তাঁবু টানিয়ে ক্যাম্পিং, বন্ধুবান্ধব মিলে বালুচরে খেলায় মেতে উঠা, গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া গরুর গাড়ি-ঘোড়ার গাড়িতে চরার মজার অভিজ্ঞতা, পালতোলা নৌকায় যমুনায় ভেসে বেড়ানো, ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বাংলার নৌকা বাইজ দেখার অভিজ্ঞতা এসবই যমুনার চরাঞ্চলের জনজীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী। সব বয়সী মানুষের মধ্যেই গ্রাম ও প্রকৃতির প্রতি আলাদা আকর্ষণ থাকে। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে কৃষির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের স্পৃহা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইট-পাথরের শহর ছেড়ে, যান্ত্রিকতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সবাই হতে চাই শিকড়মুখী। নদীতে সাঁতার কাটতে চাই, নিজ হাতে মাছ ধরতে চাই, টাটকা সবজি, ফল-ফলাদি আহরণ করতে চাই। আসলে প্রকৃতির মাঝে থাকার যে আনন্দ, তা উপভোগ করতে চাই। চরকৃষি পর্যটন এমনই এক ক্ষেত্র হতে পারে, যেটি শান্ত, নিরিবিলি আর সবুজে আ”ছাদিত একটি জায়গা, যেখানে মানুষ দূষণমুক্ত হাওয়ায় তৃপ্তি সহকারে প্রশান্তি অনুভব করতে পারা যাবে।
সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনের সম্মানিত পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন বলেন, পর্যটনকে কেন্দ্র করে যখন মানুষের যাতায়াত বেড়ে যাবে সেটাকে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে আমরা ব্যবহার করতে পারি। কাশফুলের সৌন্দর্যে আমরা সবাই মুগ্ধ হই,ছেলেমেয়েরা কাশবনে গিয়ে ছবি তুলতে পছন্দ করে। সিরাজগঞ্জে কিন্তু আমাদের প্রত্যেকটা চরে এরকম কাশবন আছে। দ্বিতীয়ত হলো চরে উৎপাদিত যত ধরনের কৃষিপণ্য আছে পর্যটক যারা এখানে ভ্রমণ করতে আসবে তাদের জন্য আমরা ব্যবহার করতে পারি। তারপর ঢাকা শহরে যেসব বরিশাল গামী লঞ্চ ছিল, পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে তাদের ব্যবসা অনেকটাই ধীর হয়ে গেছে, সেখান থেকে ভালো মানের দুটো জাহাজ নিয়ে সিরাজগঞ্জের হার্টপয়েন্ট থেকে কাজীপুরের মেঘাই ঘাট, এনায়েতপুর, চৌহালীতে ঘুরে ফিরে আমরা নদীর মধ্যেই যদি আনন্দের যায়গা প্র¯‘ত করে দিতে পারি। তিনি আরও বলেন, যারা মিষ্টি পানিতে বিশেষ করে এইসব নদী বহুল অঞ্চলে ভ্রমণ করতে চায় তাদের জন্য আমরা ভালো যায়গা তৈরি করে ফেলতে পারি। যখনই মানুষ এখানে আসবে সিরাজগঞ্জকে কেন্দ্র করে এখানকার উৎপাদিত পণ্য যেমন কাপড়, কৃষিপণ্য যা আছে তা বিক্রি করার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে। এছাড়াও দেশের সর্ব বৃহৎ দুগ্ধ ও গো মাংসের হাব যমুনা নদী কেন্দ্রিক এ অঞ্চলেই গড়ে উঠেছে এবং এখানকার তৈরি মিষ্টান্ন দ্রব্য দেশ বিদেশে খুবই জনপ্রিয়। তার মতে, সেই জন্য তিনি মনে করেন বাংলাদেশে ছোট বড় যতগুলো ট্যুরিজম গ্রুপ আছে,যারা ভ্রমণ পিয়াসি তাদেরকে আমরা আহ্বান করতে পারি এবং সিরাজগঞ্জ ভিত্তিক কিছু ট্যুরিজম গ্রুপ তৈরি করতে পারি। যেখানে সর্বোপরি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিযুক্ত করে সেখানে পর্যটনের সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে পারি। এখানে নৌ ও কৃষি পর্যটনের উন্নয়ন সম্ভব হলে যমুনা নদীর অর্থনৈতিক ব্যবহার বেড়ে যাবে, চরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণে “চরকৃষি” পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নদী কেন্দ্রিক উৎসব ও স্থানীয় শিল্প-সংস্কৃতি সংরক্ষিত হবে। পর্যটন, নদী সম্পদ ও সংস্কৃতি বিষয়ক ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে এবং নদী তীরবর্তী গ্রাম গুলো বিশেষ করে চরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। শেখ মনোয়ার আরও বলেন, যে যথাযথ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে, পর্যটন বাজারে এর যথার্থ বিপণন করতে পারলে সিরাজগঞ্জের নদী ও কৃষি পর্যটন অনন্য উচ্চতা স্পর্শ করবে এবং পর্যটন শিল্পে নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে। তিনি সব সময় ভাবেন- “ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা যে পরিবেশে বড় করছি ; আমি নিশ্চিত সেটা স্বাস্থ্যকর বা সন্তোষজনক নয়। নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্ট-কালচার, প্রকৃতি, মাটির গন্ধ আলো-বাতাসে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠবে এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা”। এই প্রত্যাশা পূরণে আমরা পরিকল্পিতভাবে সিরাজগঞ্জে নদী ও কৃষি পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি।