নাম তার দেলোয়ার হোসেন। চাকরি জীবনের শুরুটা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মেরিন বিভাগের সহকারী জাহাজ পরিদর্শক হিসেবে। তার বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এই চাকরি বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দায়িত্ব তার সহকারী জাহাজ পরিদর্শক কিন্তু অতিরিক্ত জাহাজ পরিদর্শকেরও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এর পরের গল্পটা আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্যের গল্পকেও যেন হার মানায়। সহকারী জাহাজ পরিদর্শক থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে বনে গেছেন অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক। অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি দীর্ঘ দুই দশক ধরে একইপদে বহাল তবিয়তে থাকার কারণে ভয়ে কেউ তার এসব জাল জালিয়াতি, দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করার সাহস পাননি। চট্টগ্রাম বন্দরে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তিনি এতটাই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর যে, তাকে কেউ চাকরি জীবনের শুরু থেকে সরাতে পারেননি। যেখানে মেকানিক ও আই.এম.ও সনদ থাকতে হবে বাধ্যতামূলক, কিন্তু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন ৮ বছর যাবৎ। এ বিভাগে ৭ জন আই.এম.ও সনদধারী লোক থাকা সত্ত্বেও জোড় পূর্বক একই পদে দুই দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ দেলোয়ার। আই.এম.ও সনদধারীদের উক্ত পদে পদায়ন না করে সনদ বিহীন দেলোয়ার নিজেই এই চেয়ার দখল করে আছেন যেখানে আই.এম.ও সনদধারীগন বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জাহাজ রয়েছে প্রায় চল্লিশটারও বেশি এবং এসব জাহাজের মাষ্টার, সহকারী মাষ্টার, ইঞ্জিন ড্রাইভার (ইডি), সুকানি, লস্কর, গ্রিজারসহ কর্মরত বিভিন্ন কর্মচারীদের পদায়ন বা বদলি সংক্রান্ত বিষয়ে রয়েছে তার বিশেষ প্রভাব। প্রতিটি পদায়ন বা বদলিতে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়টা ওপেন সিক্রেট। এছাড়াও বন্দরের নিজস্ব এসব জাহাজের জ্বালানি তেল বরাদ্দ নিয়ে এই সহকারী জাহাজ পরিদর্শক মো. দেলোয়ার হোসেন সক্রিয় কমিশন বাণিজ্যের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। তার এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন ইঞ্জিন ড্রাইভার (ইডি), মাষ্টার, সহকারী মাষ্টার, লস্কর এবং একজন প্রভাবশালী বন্দরের সিবিএ নেতা। প্রতিটি জাহাজে জ্বালানি তেল বরাদ্দের চাহিদাপত্র অনুমোদন করে প্রতি লিটার তেল থেক সাড়ে ৩ টাকা কমিশন নেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইঞ্জিন ড্রাইভার (ইডি)। এই কমিশনের টাকার ভাগ বাটোয়ারায় আনুপাতিক হারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে কমিশন বাণিজ্যটা অফিসিয়াল করে নিয়েছেন এই দেলোয়ার হোসেন। এছাড়াও এই তেল বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে যে কমিশন বাণিজ্য গড়ে তুলেছে তার টাকাগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে বহনের জন্য একটা সমিতির মাধ্যমে সুদের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন আরেক দেলোয়ার হোসেন ওরপে জামাই দেলোয়ারের মাধ্যমে। ইতিপূর্বে এই জামাই দেলোয়ার নগদ টাকাসহ প্রশাসনের হাতে আটক হয়েছেন বন্দর ভবনেই। আরও জানা যায়, সহকারী জাহাজ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত হলেও জ্বালানি তেল বরাদ্দের কমিশন বাণিজ্য ও পদায়ন-বদলির তদবির বাণিজ্যের টাকায় চট্টগ্রামের আভিজাত এলাকা খ্যাত খুলশিতে প্লট কিনেছেন এবং নিজ জেলা ফেণীতেও নান্দনিক বাড়ি নির্মাণ করেছেন। চবকের সামান্য সহকারী জাহাজ পরিদর্শক হলেও তিনিই অফিসের সর্বেসর্বা। মেরিন বিভাগের সব টেন্ডার তদবির বাণিজ্য করেন দেলোয়ার। চট্টগ্রাম বন্দরের অসাধু কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতার যোগসাজশে এগুলো একাই নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। অফিসের কেউ ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। তবে দেলোয়ারের এই অ‣বধ বানিজ্যের টাকা লেনদেনের জন্য রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের লস্কর, আরেক দেলোয়ার যাকে জামাই দেলোয়ার নামে সবাই চিনেন, এজন্য চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। সামান্য একজন লস্কর হয়েও এই দেলোয়ারের সম্পদও পাহাড় সমান, যা জানলে চোখ কপালে উঠে যাবে। বানিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের নিমতলায় এম.ডি.সি প্রোপারটিতে রয়েছে তার বিলাশ বহুল ২টি ফ্ল্যাট। চাঁদপুরে নিজের নামে রয়েছে একটি হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, সিতাকুন্ড জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ও লস্কর দেলোয়ার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইঞ্জিন ড্রাইভার (ইডি) বলেন-দুই দশক ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের মেরিন বিভাগ জিম্মি হয়ে আছে এই দেলোয়ারের হাতে। অথচ ভয়ে কেউ তার এসব দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করার সাহস পাননি। চট্টগ্রাম বন্দরে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাই তার কিছু হয়না। বিষয়টি জানার জন্য মো. দেলোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটি আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। আমার পোষ্টে একজন আসতে চাচ্ছে সেই বিভিন্ন জায়গায় চিঠি চালাচালি ও এসব বলে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও উপরোক্ত বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার্স এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বন্দরের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, উনার সবকিছু ঠিক আছে কিনা আমার যাচাই হয়ে গেছে। উনার সার্টিফিকেট যাচাই বাচাই করে উনাকে আমাদের সদস্য করা হয়েছে। আশা করি সব ঠিক থাকবে। এবিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, যদি সহকারী জাহাজ পরিদর্শক মো. দেলোয়ার হোসেন জাল-জালিয়াতি ও কোন অনিয়ম-দুর্নীতি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনুসন্ধানি প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে থাকছে দুই দেলোয়ারের দুর্নীতির বিস্তারিত তথ্য।