বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানী লিমিটেড তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহেদ ও প্রেসিডেন্ট মঈনুদ্দীন আহম্মদ ৪২৭ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে মোটা অংকের অর্থ বিনিময়ে ধামাচাপা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের সিইও। অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এগোতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অযাচিত হস্তক্ষেপে বিপিসির প্রায় সব প্রকল্পে ধীরগতি। পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। বাণিজ্যিক অডিটে দুর্নীতি-অনিয়মসহ আপত্তি ওঠা ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাঁচ বছরেও ব্যবস্থা নেয়নি অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বিপিসি। জানা যায় ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এসএওসিএলের ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়-ব্যয় ও অডিটসহ সার্বিক আর্থিক কর্মকান্ড পর্যালোচনার জন্য সরকারের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি। পরবর্তী সময়ে বিপিসির তদন্ত কমিটি এসএওসিএলের অসহযোগিতার অভিযোগ এনে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের শুধু নমুনাভিত্তিক কিছু আর্থিক কার্যক্রমের অনুসন্ধান করে প্রায় তিনশ কোটি টাকা অনিয়মের সত্যতা পায় কমিটি। এদিকে বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ২০২১ সালের ৯ মার্চ প্রায় ৮১ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। আগেই মারা যাওয়ায় মহাব্যবস্থাপক শাহেদকে মামলার আসামি করা সম্ভব হয়নি। উচ্চ আদালত ও অডিট অধিদপ্তরের যেসব আপত্তি ছিল, আপত্তিগুলো এখনো নিষ্পত্তি বাস্তবায়ন হয়নি। এসএসওসিএলের ২০১৩-২০১৪ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত এবং ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের অংশ বিশেষের ওপর নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সরকারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তর। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা কাজ শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেন নিরীক্ষা দলের নেতা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিসার । বাণিজ্যিক ওই অডিটে কোনো প্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ইচ্ছামতো সরাসরি আবেদনের মাধ্যমে ১৪ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার গুরুতর অনিয়ম উত্থাপন করা হয়। অভিযোগ ওঠা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন- সিনিয়র অফিসার (মেনটেন্যান্স) মো. শহিদুল ইসলাম, জুনিয়র অফিসার (টেকনিক্যাল) দুর্জয় দে, অফিসার (হিসাব) মো. ফখরুল ইসলাম ভুঁইয়া , টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনোয়ার জাহিদ, সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তী, জুনিয়র সেলস অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌ ও অপা.) মো. মোকাররম হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. মাহমুদুল হক তুষার , জুনিয়র অফিসার (অপারেশন) মো. সামীম সহিদ, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনিসুর রহমান, অফিসার (এইচআর) আবদুল্লাহ আল মামুন, অফিসার (সেলস) মীর হোসেন, ম্যানেজার (প্রোডা ও অপা.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান ও অফিস সহকারী মো. আশরাফ উদ্দিন। আরো জানা যায়, প্রতিষ্ঠানে অনুমোদনবিহীনভাবে ৫০ কোটি টাকার এফডিআর ভাঙিয়ে ৯৪ লাখ টাকা তছরুপ, বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই এসএসসি পাস না করা লোককে সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিয়োগ, মেশিন আমদানির নামে বিদেশ সফর, অনুমোদবিনহীন ভাবে গাড়ি ব্যবহার করে অর্থ অপচয়সহ নানান অভিযোগ রয়েছে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তিন বছর পার হলেও প্রতিবেদন দেয়নি কমিটি। ২০২১ সালের ১২ই এপ্রিল বিপিসি ও এসএওসিএলের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. আবু বকর ছিদ্দীকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এসএওসিএলের ৪০৬তম পর্ষদ সভায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তি ওঠা ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য চার সদস্যের কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২৬ এপ্রিল চার সদস্যের কমিটি গঠন করে অফিস আদেশ জারি করে এসএওসিএল। কমিটির এসএওসিএলের পরিচালক ও ম্যাক প্রেসিডেন্ট মিশু মিনহাজকে সভাপতি, সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ, বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ফেরদৌসী মাসুম হিমেলকে সদস্য এবং এসএওসিএলের কর্মকর্তা (হিসাব) মো. কামরুল হুদাকে সদস্য সচিব করা হয়। পরবর্তী ২৪ জুনের মধ্যে চেয়ারম্যান বরাবর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই পত্রে। কিন্তু অদ্যাবধি ওই কমিটি প্রতিবেদন দেয়নি। ওই কমিটি এখনো বাতিল বা পুনর্গঠন হয় নি । ওই কমিটি গঠন হলেও কোনো কার্যক্রম হয়নি। কোনো প্রতিবেদনও দেওয়া হয়নি। এখনো কমিটি ওই অবস্থায়ই আছে। বিপিসির চেয়ারম্যান সচিব ও বিপিসির পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ম্যাক পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও সবকিছুই দেখভাল করেন প্রধান নির্বাহী সিইও। সরকারি অডিট আপত্তিতে ওই ১৪ কর্মকর্তা বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও, ব্যবস্থা নিতে অনিহা প্রকাশ করেন সিইও মনি লাল দাশ। সরকারি অডিট বিভাগ হতে দেওয়া আপত্তি অনুযায়ী বিধিবহির্ভূত ভাবে গাড়ির ঋণ নেওয়া ও ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। অগ্রিম হিসাবে নেওয়া ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার হিসাব দেওয়ার বিষয়ে দায়ী কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা বা টাকা ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়নি। অনুমোদবিনহীন ভাবে ১৪ কোটি ৮৮ লক্ষ ৩ হাজার টাকার বিলের বিষয়ে দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পণ্য বিক্রয় করে ৫৮ লক্ষ্য টাকা আত্মসাৎকারী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন হিসাব বিভাগে বহালতবিয়তে আছে। সাবেক হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা মাহমুদুল হক তুষার অনুমোদন বিহীন ভাবে ৯ দিন আগে ৫০ কোটি টাকার এফডিআর ভাঙ্গিয়ে ৯৪ লক্ষ্য টাকা হাতিয়ে নেয়। এই বিষয়ে গত ১৩/০৭/২০২১ তারিখে বিপিসি থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এখনো পর্যন্ত অনিয়ম দুর্নীতির কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অডিট আপত্তি থাকা ১৪ কর্মকর্তারা এখনো পর্যন্ত এসএওসিএল প্রতিষ্ঠানে বহালতরিয়তে আছেন। একই পদে ২০ বছর ধরে এলপিজি বিক্রির দায়িত্বে থাকা সহকারী ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) আবদুস সালাম মীর এর বেতনের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও একই চেয়ারে এখনো পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আছে। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র শহিদুল ইসলাম সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার এক লক্ষ টাকা উচ্চ বেতনে বহাল তবিয়তে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মনি লাল দাশ এর অব্যবস্থাপনায়, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ছত্রছায়ায় রয়েছে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে কোন ভিআইপি নেই বললেই চলে, তবুও ভিআইপি কোটা পদ্ধতিতে মনি লাল দাশ প্রতিষ্ঠানে এলপি গ্যাস ও বিটুমিনের ব্যবসা করে লক্ষ লক্ষ টাকা ফায়দা হাসিল করে আসছে। জানা যায় সিইও মনি লাল দাশের এক ছেলে এক মেয়ে কানাডাতে লেখা পড়া করেন। তাঁর স্ত্রী সেপিকা দাশ একজন গৃহিণী হওয়ার সত্ত্বেও ৫৬ লক্ষ টাকা কর পরিশোধ করায় গত ০৮/০৭/২০২৪ ইং তারিখে অসাধু উপায়ে মনি লাল ও তাঁর স্ত্রী সেপিকা দাশের নামে অর্জিত স্থাবর অস্থাবর সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ প্রদান করে প্রতিবেদন দাখিল করেন দুদক। একাধিক সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক এলপি গ্যাস (বিক্রয়) আব্দুস সালাম মীর, এবং সহকারী ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) সাইফুল ইসলাম মীর, এই দুই মীর কে পদ থেকে সরিয়ে দিলে বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপিসির অধিনস্থ প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, এলপি গ্যাস লিঃ, ইন্টার্ন রিফাইনারি সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সকল এমডি দের বদলি করা হলেও অদৃশ্য কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপিসির অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মনি লাল দাশ এর অঢেল দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও, এখনো পর্যন্ত এসএওসিএল প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে বসে দুর্নীতি কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয় বিটুমিনের ও এলপি গ্যাসের সিন্ডিকেট সদস্যরা ব্যাপক মরিয়া হয়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজ মনি লাল দাশ কে উক্ত প্রতিষ্ঠানে বহাল রাখার জন্য।