ঘূর্ণিঝড় রিমাল এর তাণ্ডবে খুলনায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীর পানির বৃদ্ধি পেয়ে খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার ৩২ স্থানের বাঁধ ভেঙে যায়। এছাড়া আরও ২৩ টি পয়েন্ট থেকে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। ঝড়ে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ভেসে গেছে ৩ হাজার ৬০০ পুকুর এবং ৯ হাজার ১১৫ টি ঘেরের মাছ, চিংড়ি, কাকড়া, পোনা। এতে ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদের। জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড়ে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও রূপসা এই ছয়টি উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের তান্ডবে জেলায় ওই ছয়টি উপজেলার ৩৫৫ দশমিক ৩০ হেক্টর জমির ৩ হাজার ৬০০টি পুকুর এবং ১০ হাজার ২২৩ দশমিক ৭৫ হেক্টর জমির ৯ হাজার ১১৫টি ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেইসঙ্গে ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমির ১ হাজার ৩৫৬টি কাঁকড়া/কুচিয়া খামার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মোট ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদ। যারমধ্যে ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৭৮ মেট্রিকটন মাছ, ১১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ২ হাজার ৫৬৪ মেট্রিকটন চিংড়ি, ২০ কোটি ৫৭ হাজার টাকা মূল্যের ৬৩৬ মেট্রিকটন পোনা, ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১০২ দশমিক ২০ মেট্রিকটন কাকড়া/কুচিয়া, ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ২৭০ মেট্রিকটন পিএল, ২০ লাখ টাকা মূল্যের ২০টি নৌকা/ট্রলার/জলযান এবং ১৬ কোটি ১১ লাখ টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে খুলনায় মৎস্য চাষীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছি। এতে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার সাদা মাছ, চিংড়ি, পোনা, কাকড়া ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।
চেষ্টার পরেও সম্ভব হয়নি বাঁধ মেরামত:
খুলনার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলার বিভিন্ন স্থানের বাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এসব বাঁধের অধিকাংশ স্থান স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত সম্পন্ন করেছেন। তবে এখনো কয়েকটি স্থান দিয়ে জোয়ারে পানি প্রবেশ করছে।জলোচ্ছ্বাসে ১০/১২ নং পেল্ডারের গড়ইখালীর কুমখালীর ক্ষুদখালীর ভাঙ্গন, ২৩ নং পোল্ডারের লস্করের বাইনতলা, কড়ুলিয়াসহ ৩টি স্থানে, লতা, দেলুটি, হরিঢালী, রাড়ুলী, কপিলমুনিসহ সোলাদানার একাধিক পয়েন্টে বাঁধ উপছে লোকালয়ে লবণ পানি ঢুকে ঘর-বাড়ী, রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলের ক্ষেত তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে।
জলোচ্ছ্বাসে পাইকগাছা উপজেলার ১০/১২ নং পেল্ডারের গড়ইখালীর কুমখালীর ক্ষুদখালীর ভাঙ্গন, ২৩ নং পোল্ডারের লস্করের বাইনতলা, কড়ুলিয়াসহ ৩টি স্থানে, লতা, দেলুটি, হরিঢালী, রাড়ুলী, কপিলমুনিসহ সোলাদানার একাধিক পয়েন্টে বাঁধ উপছে লোকালয়ে লবণ পানি ঢুকে ঘর-বাড়ী, রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলের ক্ষেত তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। এছাড়া কয়রার হরিহরপুর, নয়ানি, সিংয়ের চর, ৬ নং কয়রা ও দশহালিয়াসহ দাকোপ উপজেলার একাধিক স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরজমিনে কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া গ্রামে যেয়ে দেখা যায়, সেখানের দুটি স্থানে আনুমানিক ৭০ মিটার ভেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সোমবার দুপুরের জোয়ার থেকে সেখানে লবণ পানি ঢুকছে। মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত স্থানীয় জনগণ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেন। তবে জোয়ারের পানি চলে আসায় কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি। সেখানে অর্ধশতাধিক পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। তাদের সুপেয় পানি ও খাবারের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।অসুস্থদের চিকিৎসা সেবা মিলছে না। তারা জোয়ারের সময় খাটের উপর অথবা বাঁধের উপর বসে থাকছে। অনেকের ঘর নষ্ট হয়ে গেছে। দশহালিয়ার কয়েকশ’ চিংড়ির ঘের তলিয়ে গেছে। দশহালিয়ার অসুস্থ আমিরুন বেগম (৬৫) বলেন, সোমবার দুপুরের জোয়ারে বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানি ঢুকে। ঘরের মেঝের উপরেও পানি ওঠে। রাতের জোয়ারে খাটের ওপরে বসে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। দুপুরের খাবার নেই। রান্না করতে পারছেন না কোথাও।তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসা নিতে পারছেন না।
দশহালিয়ার জহির উদ্দীন মোড়ল, হাদিউজ্জামানসহ কয়েকজন জানান, প্রতিবছর তারা প্লাবিত হচ্ছেন। দশহালিয়াতে দীর্ঘদিন ধরে বাঁধের কাজ করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাজের গতি অনেক ধীর। দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি তাদের। স্থানীয় বাসিন্দা ও পাউবো সূত্রে জানা গেছে, রোববার রাতে জোয়ারের তীব্র চাপে মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সিংহেরকোণা, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেলাল গাজীর বাড়ির সামনের বাঁধ ভেঙে । পাউবো’র উপসহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত পাওয়ার পর থেকে স্থানীয় মানুষ ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে সাথে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সুন্দরবন থেকে ২৬ মৃত ও ১৭ জীবিত হরিণ উদ্ধার, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি:
ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সুন্দরবনের । ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে কাজ শুরু করেছে বন বিভাগ। বনের বিভিন্ন স্থানে মিলছে বন্যপ্রাণীর মরদেহ। মঙ্গলবার (২৮ মে) দুপুর পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী বনের বিভিন্ন স্থান থেকে ২৬ টি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবং জীবিত অবস্থায় প্রায় ১৭ টি হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে । এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন বিভাগের ২৫টি টহল ফাঁড়ি। লবণপানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে প্রায় সকল মিঠা পানির পুকুর। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, সাধারণত জলোচ্ছ্বাস হলে বন্য প্রাণীরা উঁচু স্থান ও গাছে আশ্রয় নেয়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বনের ভেতর অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ফলে বনের উঁচু স্থান তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণীদের আশ্রয় নিতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অধিক জ্বলোচ্ছ্বাসের ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পেরে হরিণগুলোর মৃত্যু হতেপারে । সুন্দরবন বিভাগের খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী সুন্দরবনের কটকা ও দুবলা এলাকাসহ বনের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ২৬ টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া আহত অবস্থায় আরও ১৭টি হরিণ উদ্ধার করে বনরক্ষীরা। তবে হরিণের পাশাপাশি আরও বন্যপ্রাণী মারা যেতে পারে। সেসব মৃত প্রাণীর খোঁজে বনরক্ষীরা তৎপর রয়েছে।
খুলনার ৭৭ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত:
খুলনা জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য সূত্রে, ঘূর্ণিঝড়ে জেলার ৭৬ হাজার ৯০৪টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়নের ৫২টি ওয়ার্ড সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে খুলনা মহানগরীতেও অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ মানুষ। ঘূর্ণিঝড় চলাকালে বটিয়াঘাটা উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে লাল চাঁদ মোড়ল নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি গাওঘরা গ্রামের গহর মোড়লের ছেলে।