বাংলাদেশে যেকটি মুসলিম স্থাপত্য রয়েছে তার মধ্যে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া মসজিদটি অন্যতম। প্রায় ৪১৪ বছর আগে নির্মিত এই মসজিদটির কারুকাজ এখনও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলার সুলতানি এবং মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মসজিদটি দেখতে তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিদেশ থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন । আতিয়া মসজিদ যুগসন্ধিলগ্নের স্থাপত্য ও নিদর্শনরূপে পরিচিত। তবে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার না হওয়ায় অবহেলায় পড়ে আছে মসজিদটি। মসজিদটি দ্রুত সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় মুসুল্লি ও দর্শনার্থীরা। টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক এই মসজিদটির অবস্থান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথম আতিয়া মসজিদটি স্থান পায়। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও স্থান পায় আতিয়া মসজিদ। এতে দেশবাসীর কাছে সহজেই মসজিদটি পরিচিতি লাভ করে। ইতিহাস ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পঞ্চদশ শতকে এই অঞ্চলে আদম শাহ বাবা কাশ্মিরী নামের এক সুফি ধর্মপ্রচারক আসেন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। এই পুণ্যবান ব্যক্তির কবরও এখানেই অবস্থিত। শাহ কাশ্মিরীর অনুরোধে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগণার শাসক নিয়োগ করেন। সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। ‘আতিয়া’ শব্দটি আরবি ‘আতা’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো ‘দান’। ওই সময় ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য কররানি শাসক সোলাইমান কররানির কাছ থেকে বিশাল একটি এলাকা ‘ওয়াকফ’ হিসাবে পান। এটি দেলদুয়ার উপজেলা তথা টাঙ্গাইল জেলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি মসজিদটি সংস্কার করেন বলে জানা যায়। প্রাচীন এই মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ১৮.২৯ মিটার, প্রস্থে ১২.১৯ মিটার। মসজিদের দেওয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার ও উচ্চতা ৪৪ ফুট। মসজিদের চারকোনা অষ্টকোনাকৃতি মিনার রয়েছে। মসজিদটি টেরাকোটার তৈরি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদগুলো ইটের তৈরি। মসজিদটির প্রধান কক্ষ ও বারান্দা দুই ভাগে বিভক্ত। মসজিদের পূর্ব ও মাঝের দেওয়ালে রয়েছে একটি করে দরজা। বারান্দাসহ উত্তর-দক্ষিণ দেওয়ালে রয়েছে দুটো করে দরজা। ভেতরের পশ্চিম দেওয়ালে আছে তিনটি সুন্দর মেহরাব। প্রধান কক্ষের প্রত্যেক দেওয়ালের সঙ্গে দুইটি করে পাথরের তৈরি স্তম্ভ আছে। প্রধান কক্ষের উপরে রয়েছে একটি বিশাল মনোমুগ্ধকর গম্বুজ। বারান্দার পূর্ব দেওয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ। মাঝখানের প্রবেশপথের উপরের অংশের নিম্নভাগে একটি শিলালিপি রয়েছে। বর্তমানে যে শিলালিপিটি রয়েছে এর আগেও সেখানে একটি শিলালিপি ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।এই শিলালিপিটি ফার্সিতে লেখা। কোনো কারণে আদি শিলালিপিটি বিনষ্ট হলে পরবর্তীকালে মসজিদ মেরামতের সময় বর্তমান শিলালিপিটি লাগানো হয়। সরকারি এমএম আলী কলেজের শিক্ষার্থী মৃদুল হাসানসহ কয়েকজন বলেন, আতিয়া মসজিদটি দেখার মতো জায়গা। মসজিদটির কারুকাজ নজর কেড়েছে। ৬০ গম্বুজ মসজিদ, গোপালপুরের ২১০ গম্বুজ মসজিদ, কালিহাতীর নবাববাড়ী মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপস্তকলা নিদর্শন যে গুলো বাংলাদেশে রয়েছে সবই দেখতে ভালো লাগে। ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি সংস্কারের পাশাপাশি সুন্দর ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। দশ টাকার নোটে আবারো এই মসজিদের ছবি ছাপানোর জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আমরা। আতিয়া মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান ইমরান বলেন, সপ্তাহের অন্য দিনের তুলনায় শুক্রবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থী বেশি আসেন মসজিদটি দেখতে। এছাড়াও মাসে একবার বিদেশ থেকে পর্যটক আসে। তিনি আরও বলেন, মসজিদের ছাদে ও গম্বুজে ফাঁটল রয়েছে। বৃষ্টির সময় সেখান দিয়ে পানি পড়ে। মসজিদটি সাংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়নে থাকায় এলাকাবাসীর পক্ষে সংস্কার করার উপায় নেই। মসজিদের আসার যে সড়কটি রয়েছে সেটিও পাকা করা প্রয়োজন। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, আতিয়া জামে মসজিদের কথা আমি শুনেছি। পরিদর্শন করে মসজিদটি সংস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইউএনওকে বলবো খুব অল্প সময়ের মধ্যে টিআর অথবা জিআর প্রকল্পের মাধ্যমে যদি মসজিদটির সংস্কারের ব্যবস্থা করা যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ।