পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে ১৯ জনের প্রাণহানির ঘটনার অন্যতম কারণগুলো জানা গেছে। এই দুর্ঘটনার জন্য ৪টি প্রধান কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তদন্ত কমিটি। একই সাথে প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনায় রোধে ১৪টি প্রস্তাব রেখেছে তদন্ত কমিটি।
বুধবার (২২ মার্চ) সকালে মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কমিটির প্রধান মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) পল্লব কুমার হাজরা।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটির গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সাময়িক স্থগিত রাখার পরও ফিটনেসের মেয়াদ উত্তীর্ণ থাকায় তা এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলের উপযোগী ছিল না। চলাচলের অনুপযোগী গাড়িটি সময়ে সময়ে গতি বৃদ্ধির কারণে এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া চালকের পেশাদার মধ্যম লাইসেন্স থাকলেও তিনি ভারী গাড়িটি চালিয়েছেন এতে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় ১৯ জনের প্রাণহানির বিষয়ে বলা হয়, এক্সপ্রেসওয়ের উভয়পাশে গার্ড রেইল স্থাপন না থাকায় গাড়িটি বিনা বাধায় রাস্তার পাশে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পতিত হয় যার ফলে মৃত্যুহার বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলকারী দ্রæতগতিসম্পন্ন গাড়িতে সকলের সিটবেল্ট পরিধান নিশ্চিত না করার কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসাথে গাড়ির ইন্টেরিয়র যথাযথ নরম বস্তু দিয়ে তৈরি না করায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আহতের মাত্রা বেড়েছে।
এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমাতে ১৪ টি সুপারিশ রেখেছে তদন্ত কমিটি। সুপারিশে বলা হয়েছে, চালক ও সংশ্লিষ্ট সকলের লাইসেন্স এবং একটি গাড়ির সকল বৈধ কাগজপত্র নিশ্চিত করে মহাসড়কে গাড়ি পরিচালনা নিশ্চিতকরা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলকারী দ্রুত গতি সম্পন্ন গাড়ির যাত্রীদের সিটবেল্ট পরিধান নিশ্চিতে উদ্যোগ নেওয়া। গাড়ির ইন্টেরিয়র নরম বস্তু দিয়ে তৈরি করা এবং এক্সপ্রেসওয়ের উভয়পাশে গার্ড রেইল স্থাপন করা।
এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলকারী গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রম বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত জনবল ও টহল গাড়িসহ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাসের নিজস্ব চেকপয়েন্টে যাত্রীসংখ্যা চেক করার পাশাপাশি গাড়ির আগমনের সময় সংরক্ষণ ও তা সংশ্লিষ্ট দফতরসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা।
দুর্ঘটনায় আঘাতের মাত্রা কম থাকলেও দ্রুত সেবা না পাওয়ায় মৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় এক্সপ্রেসওয়ের নির্দিষ্ট দূরত্বে ট্রমা সেন্টার ও হাসপাতালের ব্যবস্থা রাখা। যাত্রীদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট পরিবহনের তত্বাবধানে সংরক্ষণ করা আবশ্যক যাতে করে আহত ও নিহত যাত্রীদের চিহ্নিত করা সহজতর হয়। দুর্ঘটনা কমানো এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ সহজতর করার লক্ষ্যে প্রতিটি গাড়িতে এবং মহাসড়কে জিপিএস ট্র্যাকার রাখা, সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও অনলাইনে তা মনিটরিং করার ব্যবস্থা রাখা। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে, বিশেষ করে রাতে, ভোরে ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় গাড়ির গতিসীমা অপেক্ষাকৃত কমিয়ে গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা। এক্সপ্রেসওয়ের প্রতিটি গাড়ির গতিবেগ ডিজিটাল ডিসপ্লেতে প্রদর্শন করে চালকদের সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া।
তদন্ত কমিটির প্রধান মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) পল্লব কুমার হাজরা বলেন, এ ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছি। দুর্ঘটনায় সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দেখেছি দুর্ঘটনায় কবলিত বাসটির ফিটনেস সনদ মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল তাই গাড়ির রেজিস্ট্রেশনটি স্থগিত করা হয়েছিল। বাসটি হাইওয়ে সড়কে চলাচলের অনুপযোগী ছিল। এই বাসটির চালক এক্সপ্রেসওয়েতে বিভিন্ন সময়ে অতিরিক্ত গতিতে চালাচ্ছিলো। বাসটির ফিটনেস সনদ মেয়াদোত্তীর্ণ থাকায় অতিরিক্ত গতিতে চালানোর উপযোগী ছিলো না। এছাড়াও চালকের ভারী গাড়ি চালানোর অনুমোদন ছিলো না। একইসাথে সকালে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা পিচ্ছিল ছিলো এবং অসতর্কতায় গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত রোববার ভোর চারটার দিকে খুলনার ফুলতলা থেকে ইমাদ পরিবহনের একটি বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। পরে ভোর ৫টা ৫ মিনিটে খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে বাসটি যাত্রী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়। বাসটির চালক সকাল সাড়ে সাতটার দিকে পদ্মা সেতুর আগে এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারায়। এতে বাসটি ছিটকে পড়ে যায়। এরপর এক্সপ্রেসওয়ের আন্ডারপাসের দেয়ালের সঙ্গে সজোড়ে ধাক্কা লেগে দুমড়েমুচড়ে যায়।
এতে ঘটনাস্থলেই চালক জাহিদ হাসান, তার সহকারী ইউসূফসহ ১৭ জনের মৃত্যু হয়। চিকিৎসার জন্য ১২ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে বাসটির সুপারভাইজার মিনহাজসহ আরও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। এ দুর্ঘটনায় ১৯ জনের মৃত্যুর পরে মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। এই তদন্ত কমিটির আহবায়ক হলেন মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) পল্লব কুমার হাজরা, কমিটির সদস্য মাদারীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মনিরুজ্জামান ফকির, বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি, মাদারীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হোসেন। এ ঘটনায় শিবচর হাইওয়ে থানার সার্জেন্ট জয়ন্ত সরকার বাদী হয়ে ইমাদ পরিবহন লিমিটেড কোম্পানির মালিক ও সংশ্লিষ্ট সকলের নামে একটি মামলাটি করেছেন।