বাগানে সারি সারি লিচুগাছ মুকুলে নুয়ে পড়ছে। মিষ্টি গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। গাছের নিচে সারি সারি মৌ-বাক্স। সেখান থেকে দলে দলে মৌমাছির ঝাঁক উড়ে গিয়ে বসছে মুকুলে। মধু সংগ্রহ করে আবার ফিরে যাচ্ছে মৌ-বাক্সে। উত্তরের জেলা গুলোতে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে প্রচুর লিচুবাগান। সেসব বাগানের গাছ এখন মুকুলে ছেয়ে গেছে। এসব বাগান ঘিরে মৌ চাষ করছেন খামারিরা।
সুস্বাদু, মিষ্টি এ মধু মৌমাছির মাধ্যমে আহরণ করছেন মৌ-চাষিরা। এতে বাগানিরা ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, লিচুর মুকুলে মৌমাছি বসলে পরাগায়ন ভালো হয়। ফলে একদিকে লিচুর উৎপাদন যেমন বাড়ছে, তেমনি মধুও আহরণ করা যাচ্ছে। সমন্বিত এ চাষে লিচুচাষি ও মৌচাষি দুজনই লাভবান হচ্ছেন। গত বছর দিনাজপুরে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার মধু আহরণ হয়েছে। এবার লিচুর মুকুল থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার মধু উৎপাদন সম্ভব হবে বলে আশা করেন উত্তরবঙ্গ মৌ চাষি সমিতির সদস্য মোসাদ্দেক হোসেন। কথোপকথনে মোসাদ্দেক জানান, ‘দিনাজপুর জেলায় যে পরিমাণ লিচু বাগান আছে, এটা যদি সুশৃঙ্খল অবস্থায় গাণিতিক আকারে পরিচালনা এবং মৌখামারিদের সেভাবে বিন্যস্ত করা যায় তাহলে দিনাজপুর থেকে শত কোটি টাকার মধু আহরণ করা সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, এখানে একটি মৌ-গবেষণাগার স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি। যদি মৌ-গবেষণাগার স্থাপন করা যায় তাহলে এ অঞ্চলকে সুন্দরবনের পর মধুর প্রধান আহরনের এলাকায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’
দিনাজপুরের বিভিন্ন লিচুর বাগানে মৌ-বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছে ৪৫০ মৌখামারি। মধু চাষের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে উৎপাদন আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন মৌ-খামারিরা। ঠাকুরগাঁও জেলায় এবার রেকর্ড সংখ্যক মধু আহরিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ৯৪৫ হেক্টরের বেশি জমিতে লিচুর বাগান আছে। এ ছাড়া জেলার অনেক এলাকার বাড়ির আঙিনায় ও আশপাশের ভিটাবাড়িতে লিচু চাষ করা হয়। বাগানের লিচুর জাতের মধ্যে রয়েছে গোলাপি, চায়না থ্রি, মাদ্রাজি ও বোম্বে। সদর উপজেলার গোবিন্দনগর, মুন্সিরহাট, নারগুন, আকচাসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সেখানের লিচুবাগানে মৌ-বাক্স বসিয়েছেন খামারিরা। তাঁরা নাটোর, খুলনা, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন। কেউ কেউ অন্য এলাকার। মৌ-বাক্স ঘিরে চলছে তাঁদের কর্মযজ্ঞ। মুকুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছি। সেই মৌমাছিকে মৌ বাক্সে রাখেন কর্মীরা খুলনার ডুমুরিয়া থেকে মৌ-বাক্স নিয়ে শহরের গোবিন্দনগর এলাকায় এসেছেন খামারি তারেক হোসেন। একদল কর্মী সেসব বাক্স দেখভাল করছেন। তাঁদেরই একজন রিপন ইসলাম বলেন, প্রতিবছর এখানে মৌ-বাক্স নিয়ে আসেন তাঁরা। প্রতিটি বাক্সে একটি করে রানি ও পুরুষ মৌমাছি এবং অসংখ্য কর্মী মৌমাছি আছে। কর্মী মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে যায় লিচুর মুকুলে। মুকুলে মুকুলে গিয়ে মৌমাছি পুরুষ ফুলের পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে স্থাপন করে পরাগায়ন ঘটায়। সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করে নিজ নিজ বাক্সের মৌচাকে এনে জমা করে। নাটোর থেকে মধু সংগ্রহে আসা আওলাদ আলী বলেন, মধু সংগ্রহের জন্য তাঁরা মাসখানেক একটি বাগানে থাকেন। প্রতিটি গাছের নিচে ৪০ থেকে ৫০টি মৌমাছির বাক্স রাখেন। এক চেম্বারের প্রতিটি বাক্সে ১০টি এবং দুই চেম্বারের একটি বাক্সে ২০টি ফ্রেম থাকে। ১০ ফ্রেমের একটি বাক্সে ২০ হাজার পর্যন্ত মৌমাছি থাকে। পাঁচ থেকে সাত দিন পর বাক্সগুলো থেকে ফ্রেমে থাকা মৌমাছিগুলো সরিয়ে যন্ত্রের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করা হয়। খামারি তারেক হোসেন বলেন, ৩৭টি মৌ-বাক্স নিয়ে মধু সংগ্রহ শুরু করেছিলেন তিনি। বর্তমানে তাঁর ৭৭৫টি বাক্স আছে। সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে লিচুর মুকুল থেকে বেশ ভালো মধু পাওয়া যায়। আর এতে ভালো ব্যবসাও হয়। বাগানমালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লিচুর ফুলের পরাগায়ন না হলে ফলন কম হয়। লিচুগাছে মুকুল এলে তিনি নিজেই মৌচাষিদের ডেকে আনেন। একই কথা জানান মুন্সিপাড়া এলাকার বাগানমালিক রমজান আলী।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু হেসেন বলেন, লিচু একটি পরাগায়িত ফল। লিচুবাগানে মৌ-বাক্স বসালে মৌমাছি উড়ে উড়ে লিচুর ফুলে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে লিচুর ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। এতে অন্তত ২০ শতাংশ ফলনের পাশাপাশি লিচুর আকার-আকৃতিও বাড়ে। আবার মধুও পাওয়া যায়। লিচুবাগানে মধু সংগ্রহ করলে লিচুচাষি ও মৌচাষি দুজনই সুফল পান।