চট্টগ্রাম মৎস্য বন্দর হতে চুক্তি ভিত্তিক ভাড়ায় নেওয়া এফ.ভি. রূপচান্দা নামক একটি ফিশিং ট্রলারে প্রায় ৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়ার অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ী আবু বক্কর ছিদ্দিক। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতায় কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে দাবি করেছেন ওই ব্যবসায়ি।
ভুক্তভোগি দাবি করেছেন, বিনা নোটিশে এফ.ভি রুপচান্দা ট্রলারটি জোর করে তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি কৌশলে বিএফডিসি তার কাছ থেকে ৫৩ লাখ ১৫ হাজার ৩৫৮ টাকা আদায় করেছেন বলে তিন জানান। কিন্তু বিএফডিসি ও চট্টগ্রাম মৎস্য বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা বলেছেন, ‘ভাড়া চুক্তি শেষ হওয়ায় ট্রলারটি নিয়ে ফেলা হয়েছে। যেহেতু ওটা সরকারি সম্পত্তি। চুক্তি সম্পাদন ছাড়া কাউকে দেওয়ার সুযোগ নেই।’
এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে চট্টগ্রাম মৎস্য বন্দরের মহাব্যবস্থাপক ও অন্যান্য দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামস্থ এমএ আবু বক্কর ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর জনৈক আবু বক্কর ছিদ্দিক। কিন্তু কোন প্রতিকার পাননি বলে জানান।
এছাড়াও সম্প্রতি এসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে দুর্নীতি দমন কমিশনেও একটি লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। এতে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান কাজী আশরাফ উদ্দিন, একই দপ্তরের ক্রয় ও বিপনন শাখার পরিচালক মো. মনজুর হাসান ভুঁইয়া (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), যুগ্ম পরিচালক মো. হারুন অর রশিদ, বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপক মাসুদুল আলম, চট্টগ্রাম মৎস্য বন্দরের মহাব্যবস্থাপক এম আর কে জাকারিয়া ও ট্রলার ম্যানেজার মো. আমির হোসেনের উপর অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগে এফ.ভি. রূপচান্দা ফিশিং ট্রলারের পরিচালক আবু বক্কুর জানান, ‘মেসার্স পদ্মা এজেন্সির যাবতীয় বকেয়া ভাড়া পরিশোধ ও ট্রলারটি মেরামত করে সাগরে যাওয়ার উপযোগি করেছেন তিনি। পাশাপাশি বিএফডিসির যাবতীয় শর্তাবলী পূরণ করে প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি নিয়ে ট্রলারটি পরিচালনার নির্দেশও পেয়েছিলেন। যার কারণে মেরামত কাজ সম্পন্ন, ট্রলারের বিদ্যুৎ বিল, কর্মকর্তা কর্মচারীর বেতন ভাতা, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে খরচ ও অন্যান্য খাতে ব্যবসায়ী আবু বক্করের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। বিপরীতে ট্রলার সার্ভে করনের অনুমতি প্রদান, ট্রলার সমুদ্রে গমনের সিলিং অনুমতি প্রদান, ফিশিং ট্রলারে কমপ্রেসার ও রাডার স্থাপনের অনুমতি প্রদান, বেতার লাইসেন্স ফি পরিশোধ, ট্রলার ডকিং করার অনুমতি প্রদানসহ যাবতীয় বিষয়ে চট্টগ্রাম মৎস্য বন্দর তখন সহযোগিতা করে। যার সমস্ত কাগজপত্র রয়েছে।’
কিন্তু গত দুই বছর মহামারি করোনা পরিস্থিতির কারণে ট্রলার সমুদ্রে গমনে প্রতিবন্ধকতা ও ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে ব্যবসায়ী আবু বক্করও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন। ট্রলারের কর্মচারীর বেতন, ব্যাংক ইন্টারেস্টসহ ট্রলার ভাড়া পরিশোধ করে আর্থিকভাবে দোটানায় পড়েন। এভাবেই প্রায় ৪ কোটি টাকারও অধিক খরচ হয়ে যায়। এরমধ্যে গত ২১ জুলাই ট্রলারটি মৎস্য বন্দরের হেফাজতে নেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী প্রধান কার্যালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে ৭ আগস্ট ট্রলারটি হেফাজতে না নিতে এবং আর্থিক ক্ষতি বিবেচনায় চুক্তি সম্পাদনের অনুরোধ জানান। গত ২২ সেপ্টেম্বরে ট্রলারটি সমুদ্রে গমনের অনুমতি রহিতকরণ করে ৪ অক্টোবর মৎস্য বন্দরের হেফাজতে নেওয়ার চিঠি দেন।
বিষয়টি জানার পর একাধিকবার চিঠি দিলেও মৎস্য বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার উত্তর না দিয়ে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনা না করে ০৩ (তিন) কার্যদিবসের মধ্যে ট্রলার হস্তান্তরে জন্য পুনরায় চিঠি দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, ‘আমি কোনো অবৈধ ট্রলার পরিচালক নই। কার্যালয়ের যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করেছি। আমি কর্পোরেশনের সকল নিয়ম নীতি অনুসরণ করে ট্রলারটি পরিচালনা করেছি। ট্রলারটিতে প্রায় ৪ কোটি টাকার অধিক আর্থিক বিনিয়োগ করেছি।’
তিনি আরও বলেন, বেআইনি প্রক্রিয়ায় আমার কোনো প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে এফ.ভি. রূপচান্দা ট্রলারটি আমার জেটি হতে বিএফডিসির জেটিতে নিয়ে যায়। যা সম্পূর্ণ অন্যায়, বেআইনি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। এখন আবার নিলাম ডেকেছে। আমি নিলাম বাতিল চাই। কারণ আমার সাথে যে লেনদেন তা শেষ না করে, নতুন করে নিলাম কল করাও এক প্রকার অনিয়ম।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মৎস্য বন্দরের মহাব্যবস্থাপক কমান্ডার (বিএন) এম আর কে জাকারিয়া বলেন, ‘এফ.ভি. রূপচান্দা ট্রলারটি বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) সরকারি সম্পত্তি। সে সুবাধে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় ট্রলারটি হেফাজতে নেয়া হয়েছে। কেড়ে নেয়া হয়নি। কারণ এখনো যিনি ট্রলারটি পরিচালনা করেছিলেন তাঁর লোকজন ট্রলারে রয়েছে। সুতরাং বিএফডিসি যা সিদ্ধান্ত দেয়, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান কাজী আশরাফ উদ্দিন এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি। তবে চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব এস এম নাসির উদ্দিন বলেন,‘ব্যবসা করার জন্য ট্রলারটি চুক্তিভিত্তিক ভাড়া নিয়েছিলেন ব্যবসায়ি। প্রকৃতপক্ষে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ট্রলার ফেরত দেওয়ার জন্য তাঁকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ট্রলারটি ফেরত না দিয়ে নিজের হেফাজতে রেখেছেন। কেড়ে নেওয়া হয়নি। আপনারা অফিসে গেলে সব দেখতে পারবেন। অনিয়ম কিছু করা হয়নি। সমস্ত নিয়ম মেনে সরকারি সম্পত্তি রক্ষার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
একান্ত সচিব আরও বলেন, ‘সে যদি পূনরায় ট্রলারটি নিতে চান তাহলে নিয়ম মেনে টেন্ডারে অংশ্রগণ করতে পারে।’
একই প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম পরিচালক মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বিষয়টি চট্টগ্রাম মৎস্য বন্দরের মহাব্যবস্থাপক দেখাশোনা করেন। যদি কোন ভুক্তভোগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মনে করেন তাহলে উনার সাথে দেখা কথা বলতে পারেন।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক (বাস্তবায়ন) মোঃ মাসুদুল আলম বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁকে ট্রলারটি পরিচালনা করার জন্য দেওয়া হয়েছিলো। মেয়াদ শেষ হলে নিয়ে ফেলা হয়েছে। কোন মৌখিক ভাবে দেয়া হয়নি ট্রলারটি। কাগজপত্র সব হয়তো আপনাদের দেখাননি। আর সে যেহেতু ব্যবসায় নামছে লাভ-ক্ষতির বিষয়টি তাঁর। ক্ষতি হয়েছে বলে সবাই দাবি করেন কিন্তু সব দাবি তো আর অফিস পূরণ করা যায় না।’