ঢাকায় বাসাবাড়িতে কাজ দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন বয়সী নারী ও শিশুদের ফুসলিয়ে ভারতে পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ভয়ংকর এই পাচারকারী চক্রটি এলাকার তরুণী, কিশোরী ও শিশুদের নিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পাচার করছে। পাচার হওয়া এসব নারী-শিশুদের বিক্রি করা হচ্ছে যৌনপল্লীতে। করানো হচ্ছে অসামাজিক কার্যকলাপ। তাদের কথার অবাধ্য হলেই করা হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। পাচারের জন্য সংঘবদ্ধ এই চক্রটি বেছে নিচ্ছে হতদরিদ্র ও ঋণগ্রস্ত পরিবারের মেয়েদের। অনুসন্ধানে জানা যায়, বেলকুচি উপজেলার দেলুয়া গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা হতদরিদ্র ফাতেমা খাতুনের ১৩ বছর বয়সী মেয়ে মারুফা খাতুনকে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় এসপির বাসায় কাজ দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যান মুকন্দগাঁতী পশ্চিমপাড়ার মায়া খাতুন। দুই মাস পর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মায়ার কাছে যান ফাতেমা। কিন্তু মায়া মারুফার বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। তিন মাস পর মারুফা একটি ইমো নম্বর থেকে ফোন দিয়ে তার মাকে বলে, তাকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। অনেক নির্যাতন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মায়ার সঙ্গে কথা বলে মারুফাকে ফেরত চাইলে তখন আবোল তাবোল বলেন তিনি। বাধ্য হয়ে ফাতেমা থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরও মেয়েকে ফেরত না পেয়ে আদালতে মানবপাচারের অভিযোগে পিটিশন মামলা দায়ের করেন। কিন্তু পিটিশন মামলাটি তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে পিবিআই। এভাবেই একটি নাবালিকা পাচারের ঘটনা মাটিচাপা দেওয়া হয়। পরে বাদী আদালতে নারাজি দাখিল করলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। এদিকে অনুসন্ধানে দেলুয়া গ্রামে আরও কয়েকটি ভুক্তভোগী পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। বছর তিনেক আগে সোবহানের মেয়ে বন্যাকে বাসাবাড়িতে কাজ দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যায় দালালচক্র। এরপর তাকে ভারতে পাচার করা হয়। সেখানে একটি যৌনপল্লীতে তাকে বিক্রি করা হয়। বন্যা সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। বন্যা বলেন, সংসারে অনেক ঋণ ও অভাব ছিল। তখন একজন দালাল এসে আমার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এবং বাসাবাড়িতে কাজ দেওয়ার কথা বলে আমাকে নিয়ে যায়। আমি তাদের সঙ্গে চলে গেলে আমাকে তারা ভারতে পাঠিয়ে দেয়। কলকাতার দালাল আমাকে নিয়ে গিয়ে খারাপ কাজ করায়। আমি দুই-তিন মাস থাকার পর পালিয়ে এসেছি। একই গ্রামের মৃত আবু বক্কার সিদ্দিকের মেয়ে রোজিনা খাতুনকেও (২৬) এভাবেই পাচার করা হয়। তিনিও বন্যার মতোই যৌনপল্লী থেকে পালিয়ে গেছেন। তবে তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। ইমোতে পরিবারের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা বলেন রোজিনা। রোজিনার মা জমেলা খাতুন বলেন, বাসাবাড়িতে কাজের জন্য মেয়েকে দিয়েছিলাম। পরে শুনি মেয়ে আমার ইন্ডিয়ায়। মেয়েটা চালাক-চতুর। তাকে খারাপ কাজে দিয়েছে দেখে পালিয়ে গেছে। মেয়ে এখন কোথায় আছে জানিনা। তবে ইমো নম্বরে মেয়ে ফোন দিয়ে জানায়, সে একটি বাসাবাড়িতে কাজ করছে। একই গ্রামের আক্তার হোসেনের দুই মেয়ে আয়েশা ও এ্যামিকে পাচার করা হয়েছিল ভারতে। তাদের মধ্যে এ্যামি ফিরে এলেও আয়েশা রয়ে গেছেন সেখানেই। আয়েশা-এ্যামির মা হামিদা খাতুন বলেন, আমার এক মেয়ে থাকতে পারে নাই চলে এসেছে। আরেক মেয়ে ভালোই আছে। দুই-তিন মাস পর পর ১০/১২ হাজার করে টাকা পাঠায়। তবে সে কোথায় আছে সেটা জানাতে পারেননি তিনি। দেলুয়া গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান, তাঁত শ্রমিক মাহমুদুলসহ অনেকেই বলেন, আমাদের গ্রামের মেয়েদের কিছু অসাধুচক্র ঢাকায় কাজ দেওয়ার কথা বলে বিদেশে পাচার করেছে। বিষয়টি আমরা পরে জানতে পেরেছি। আসলে পরিবারের পক্ষ থেকে এসব বিষয় গোপন রাখা হয়। জানা যায়, এই চক্রটি বেলকুচির বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেক মেয়েকেই পাচার করেছে। তাদের অনেকেই দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরতে পেরেছেন, কেউবা ভারতেই রয়ে গেছেন। ফাতেমা খাতুন বলেন, আমার মেয়েকে যারা নিয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার পর পুলিশ একজনকে আটক করেছিল। সেদিন গভীর রাতে আমাকেও থানায় নিয়ে যান এসআই সালাউদ্দিন। এরপর অদৃশ্য কোনো কারণে ওই আসামিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে এসআই সালাউদ্দিন বলেন, ফাতেমার অভিযোগ পেয়ে আমরা মুরসালিন নামে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছিলাম। তবে অভিযোগে তার নাম না থাকা এবং ছেলেটি নাবালক হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তখন আমাদের বলা হয়েছিল, ঢাকায় এক পুলিশের বাসায় মেয়েটিকে কাজে রাখা হয়েছে। অভিযোগে পাচারের কথা উল্লেখ ছিল না। ইন্ডিয়ায় নিয়েছে সে কথাও উল্লেখ ছিল না। বাদী ফাতেমা তার মেয়েটাকে মায়া খাতুন নামে এক নারীর কাছে কাজে দিয়েছে। ওই নারী বিভিন্ন মেয়েকে বিভিন্ন জায়গায় কাজে দেয়। মায়া খাতুন অনেক মেয়েকে ভারতে নিয়ে গেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অন্য কোনো মেয়ের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। এদিকে পিবিআই পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম বলেন, এটা ছিল কোর্ট পিটিশন মামলা, তাই গ্রেপ্তার বা জব্দ করা যায় না। আমরা যখন তদন্ত করি তখন বিবাদী বলছে সে জানে মেয়েটি ইন্ডিয়ায় পার্লারে কাজ করছে। এখন সেফহোমে আছে। কিন্তু অ্যাড্রেসটা দিচ্ছে না। যেহেতু ভিকটিমকে উদ্ধার করা যায় নাই, সেহেতু ঘটনাটি প্রমাণ করা যায় নাই। তিনি বলেন, সিআর মামলা তদন্তে কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না। ফাতেমার দায়ের করা মামলার আসামি আব্দুল বাতেন বলেন, আমি চরমপন্থী দলের আত্মসমর্পণকারী একজন সদস্য। আমার বিরুদ্ধে যে পাচারের মামলা দিয়েছে তাকে আমি চিনি না। তবে আমার বড় বোন কাজের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের পাঠায়। ফাতেমা নামে ওই বাদী আমার বড় বোনের সঙ্গে কথা বলে তার মেয়েকে কাজের উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ায় পাঠায়। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তার মেয়ে ইন্ডিয়ায় আটক হয়। এ বিষয়ে অভিযুক্ত মায়ার সঙ্গে কথা বললে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সিআইডি পরিদর্শক মোহায়মেনুল ইসলাম বলেন, এটা কোর্ট পিটিশন মামলা। প্রথমে পিবিআই তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছে বাদীর বিরুদ্ধে। পরে বাদীর নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। ভিকটিম ইন্ডিয়ায় আছে। তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথাও হয়েছে। ওই মেয়েকে ইন্ডিয়া থেকে নিয়ে আসতে পারলে বিস্তারিত ঘটনা জানা যাবে। এটা একটা সিআর মামলা, শুধু একটা তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে আমাদের কাছ থেকে। প্রাথমিক তদন্তে আমরা যেটা পাবো সেই প্রতিবেদন আদালতে দিয়ে দেব।