টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট ও সুনামগঞ্জে নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার রূপ নিয়েছে। কোম্পানীগঞ্জে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। জৈন্তাপুরে অতিবর্ষণে টিলা ধসে চার জন আহত ও সুনামগঞ্জে পানির স্রোতে নৌকা ডুবে তিন শিশুর সলিল সমাধি ঘটেছে। সিলেট শহরসহ বিভিন্ন স্থানে পানি উঠেছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। আউশ ধান প্লাবিত। সব কয়টি নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছে চলে এসেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, রবিবার বেলা ৩টায় সুনামগঞ্জের শহরে নিকট সুরমা ১১ সে.মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে শনিবার ছাতকে সুরমার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে রবিবার আরো বৃদ্ধি পায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রবিবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপত্বি করেন জেলা প্রশাসক দিদরুল আলম মো. মকসুদ চৌধূরী। সভায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সংশ্ল্লিষ্টদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ‘আবহাওয়া সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জে ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। এতে সুনামগঞ্জের সব নদনদীর পানি আরো বাড়তে পারে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।’ সুনামগঞ্জ জেলায় পানির চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
টিলা ধসে অন্তঃসত্তাসহ একই পরিবারের চার জন আহত:
অন্যদিকে সিলেটে বিভিন্ন স্থানে টিলা ধসের আশঙ্কা প্রবল। এদিকে জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ঠাকুরের মাটি পশ্চিম চটি গ্রামে শনিবার টিলা ধসের ঘটনায় তিন জন আহত হয়েছেন। জয়নাল মিয়ার বসতঘরে মাটিচাপা পড়েন তার চার মাসের অন্তঃসত্তা স্ত্রী ফাতেহা বেগম (৩০)। পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা ফাতেহাকে উদ্ধার করে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যান। জয়নাল জানান, দুপুরে হঠাৎ করে কিছু বুঝে উঠার আগেই বসতঘর সংলগ্ন টিলা ধসে পড়লে স্ত্রী মাটি চাপা পড়ে তিনি-সহ পরিবারের চার জন আহত হন।
হাওরের স্রোতে নৌকা ডুবে তিন শিশুর মৃত্যু:
সুনামগঞ্জের গোবিন্দপুরে হাওরে নৌকাডুবিতে একই পরিবারের তিন জনের মৃত্যু হয় রবিবার দুপুরে। সদর উপজেলার লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে এই দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ইউপি সদস্য মহিনুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান নিহতরা হলগোবিন্দপুর গ্রামের মাঝের বাড়ির সোহেল মিয়ার মেয়ে তন্নি (১২), তান্নি (৮) ও ছেলে রবিউল (৩) মহিনুর। হাওরের পাড়ের শিশুরা একটি নৌকা করে সড়কে আসতে গিয়ে হাওরের স্রোতে নৌকা পানিতে ডুবে তাদের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া বইছে।
মানুষের মধ্যে যত শঙ্কা:
ভারতের বরাক নদীর ঢল নেমে কানাইঘাটে সুরমায় পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে রবিবার বিকাল ৩টায় বিপৎসীমার দশমিক ৫ সে.মিটার নিচে পৌঁছে এবং সিলেট শহরের নিকট পানি বৃদ্ধি পায়। এ সময় এখানে সুরমা বিপৎসীমার দশমিক ৯৫ সে.মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ছাতক উপজেলায় সুরমা বিপৎসীমা অতিক্রম করে রবিবার সকালে দশমিক ৮২ সে.মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড রবিবার সকাল ৯টায় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৩৩২ মিলিমিটার, ছাতকে ৮১ মি.মিটার, লাউড়ের গড়ে ১১১ মি.মিটার, সিলেটে ৯২ মি.মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর শেওলা, ফেঞ্চুগঞ্জ, সারি নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে সিলেট অঞ্চলের মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে। গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। সেই শঙ্খা এখনো বিরাজ করছে—বিশেষ করে সুনামগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে।
নগরীতে জলাবদ্ধতা:
সিলেটের প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদী খাল বিলে পানি বেড়েই চলছে। সিলেট আবহাওয়া অফিস জানায়, আরো পাঁচ দিন বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে রবিবার ১৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ঢলের পানি সুরমা, জাদুকাটা ও সীমান্ত নদী দিয়ে এসে নিম্নাঞ্চলে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ নদীর পানি বিপৎসীমার কাছে এসেছে। নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় ও বর্ষণ অব্যাহত থাকায় শহর ও জনপদে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জনজীবন বিপর্যস্ত । সাধারণত বৈশাখে বৃষ্টি ও ঢল নামে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। ধান ঘরে তোলার পর মানুষ হাওরের পানির জন্য হাহাকার করেন। বৃষ্টির অভাবে জীববৈচিত্রে প্রভাব পড়তে শুরু করে। অবশেষে আষাড়ে বৃষ্টি ও ঢল আসে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জুন মাসে সুনামগঞ্জে ১ হাজার ৩১৬ মি. মিটার বৃষ্টি হয়। যা সারা দেশের চেয়ে বেশি।
৮০ হেক্টর আউশ জমি প্লাবিত:
সুনামগঞ্জে দেরিতে বৃষ্টি হলেও এখন বানের পানিতে টইটম্বুর হাওর জনপদ। সিলেটে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, পিয়াইন, ধলাই, জাদুকাটাসহ ছোটবড় সব নদীর পানি বেড়েছে। সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক জানান, আউশ ধান পাকার আগ মুহূর্তে ছাতক, দিরাই ও জামালগঞ্জে ৮০ হেক্টর আউশ জমি প্লাবিত হয়েছে। তবে পানি নেমে গেলে তেমন ক্ষতি হবে না।
পাঠানটুলা সড়কে হাঁটু পানি:
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাঠানটুলা সড়কে হাঁটু পানি। বারবার আটকে যাচ্ছে যানবাহন। এখানে সড়ক সংস্কার হচ্ছে বলে পানি আটকে আছে। এলাকাবাসী বলেন, পানি নামার ব্যবস্থা করে দিলে ড্রেনে চলে যাবে জমাট পানি।