ফরিদপুরের সদরপুরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শাহ ইমতিয়াজ আসিফ এন্টারপ্রাইজের চরম অব্যস্থাপনা, পেশি শক্তির প্রয়োগ ও সীমাহীন অনিয়মের কারণেই অকালে ঝরে গেছে তিন নির্মাণ শ্রমিকের প্রাণ। এমন অভিযোগে স্থানীয় এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ও প্রশাসন চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিচার চাইলেন নিক্সন চৌধুরীঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিচার চাইলেন নিক্সন চৌধুরী। বুধবার (৩১ মে) উপজেলার জমাদ্দার ডাঙ্গি গ্রামে একটি ব্রিজ নির্মাণের সময় মাটি ধসে প্রাণ হারায় নির্মাণ শ্রমিক আবেদ খান (২৩), জুলহাস(২৪), অন্তর শেক (২২)। এ সময় মাটির নিচের চাপা পড়ে গুরুতর আহত হয় নজরুল ইসলাম। তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। দুর্ঘটনা পর পরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সব লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় চরম ঝুঁকিতে পাকা ভবনসহ ৩৩ হাজার হাইভোল্টেজের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। বিষয়টি জানতে পেরে ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, সদরপুর উপজেলার জমাদ্দার ডাঙ্গি গ্রামের একটি খালের ওপর ২৫ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার চওড়া একটি ব্রিজ নির্মাণের কাজ পায় ইমতিয়াজ আসিফ এন্টারপ্রাইজ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ইসতিয়াক আরিফের ছোট ভাই ইমতিয়াজ আসিফ । বড় ভাইয়ের ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ও স্থানীয়দের কথা অমান্য করে রাতের আধারে নিয়ম বর্হিভূতভাবে মাটি খননসহ পাইলিংয়ের কাজ করে। ব্রীজের পাশেই থাকা একটি একতলা ভবন ও ৩৩ হাজার হাইভোল্টেজের লাইনে খুঁটির নিচের অংশের প্রায় ১৫ ফিট গভীর করে মাটি খনন করে। মাটি খনন করায় ভবনটির বেজমেন্ট ও বিদ্যুতের খুঁটির নিচের অংশ বেরিয়ে পড়ে। গত কয়েকদিন ধরেই ভবন মালিক ওবায়দুর রহমান ও পাশের বাড়ির টিনশেট ঘরের মালিক তারেক ব্যাপারি ঠিকাদারকে কাজে বাধা দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রিজের সাইডে কাজ করা ঠিকাদারের সহকারী ছিদ্দিক, ম্যানেজার সোহেল ও পাহারাদার জাহাঙ্গীর ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের চাঁদাবাজির মামলার হুমকি প্রদান করে। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় বেশ কয়েকবার দেন দরবারেরও খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আজাহার শেখ বলেন, আমি নিজে ঠিকাদারকে নিষেধ করেছি। তারপরও সে ক্ষমতা দেখিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষতি করে তার কাজ সে করেই যেতে থাকে। ঠিকাদারের অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখন যদি প্রশাসন জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তবে একতলা ভবনটি ও বৈদ্যুতিক খুঁটি যে কোনো সময় ভেঙে পড়ে যাবে। ভবনের মালিক ওবায়দুর রহমান বলেন, আমি এই ঘটনার পর পরিবার পরিজন নিয়ে ভবন থেকে বের হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করিতেছি। অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য গ্রহণের জন্য কাউকেই সরেজমিনে এবং মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি জানতে পেরে ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী তার দলীয় নেতা-কর্মীদের পাঠিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজ খবর নেন। এ সময় স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মুঠোফোনে তিনি বলেন, সংসদে বাজেট অধিবেশন চলার কারণে আমি এই মুহূর্তে এলাকায় আসতে পারছি না। তবে আমার দলীয় নেতা-কর্মীরা সব সময় খোঁজ খবর নিচ্ছে। আমি আশা করব প্রশাসন সঠিক তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করবেন। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন দিয়ে দেশকে যখন উন্নত দেশে পরিণত করছে ঠিক তখনই একটি মহল এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের স্বার্থ আদায় করছে। এলাকাবাসীর ক্ষতি করে যারা এই অপকর্ম করেছে তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। সংবাদটি শুনে আমি অনেক মর্মাহত হয়েছি। নিহতদের আত্মার শান্তি কামনাসহ এলাকাবাসীর সঙ্গে আমি ফোনে কথা বলেছি। বিষয়টি নিয়ে সদরপুর উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মোমিন বলেন, ইমতিয়াজ আসিফ এন্টারপ্রাইজকে আমরা কাজটি দিয়েছিলাম। তবে তার বিরুদ্ধে কাজের শুরু থেকেই বিভিন্ন অভিযোগ ছিল। আমরা ঘটনার তদন্তর আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছি। তবে একটি কথা আমরা নিজেরাও অনেক সময় কিছু লোকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ি। বিষয়টি আপনারা বুঝতে পারছেন। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আইনানুগ সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ফরিদপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ভাঙ্গা সার্কেল) হেলালউদ্দিন জানায়, ঘটনার পর স্থানীয় জনতা ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন মাটির নিচ থেকে ৩ নির্মাণ শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করে। এ বিষয়ে সদরপুর থানায় একটি ইউডি মামলা দায়ের হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো লিখিত অভিযোগ আসে নাই। পুলিশ তদন্ত করে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অপরদিকে ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) লিটন আলীকে আহবায়ক করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন গণপূর্ত নিবার্হী প্রকৌশলী বরুণ কুমার বিশ্বাস, সড়ক ও জনপদের নিবার্হী প্রকৌশলী মো. ইমরান ফারহান ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম সাহা। তদস্ত কমিটিকে আগামী সাত কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার ঘটনাটিকে মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক উল্লেখ করে জানান, তদন্তে কারও গাফেলতি প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।