জেসন গিলেস্পির ফুলার লেন্থ বলে চিরাচরিত সেই কাভার ড্রাইভ। হাই ব্যাকলিফ্ট। এরপর ব্যাট-বলের নিখুঁত রসায়ন।
ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম তুলতে ক্রিকেটের বরপুত্রের দরকার ছিল মাত্র ১ রান। বল বাউন্ডারির দড়িতে আঁচড়ে পড়ার আগেই দুই হাত উপরে উঠিয়ে উদযাপন। বিমর্ষ হয়ে থাকা স্টিভ ওয়াহার মুখটা হয়ে গেল আরও মলিন। লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকা ব্রিজটাউনে শুধু একটাই নাম, ‘লারা…লারা…লারা….লারা…।’
ক্রিকেটদেবতা ৯৯-র ৩০ মার্চ ব্রায়ান লারাকে এমন কিছু উপহার দিয়েছেন, যা তাকে বানিয়েছে কিংবদন্তির থেকেও বড় কিছু, সেরাদের সেরা, মহাকালের সেরা নায়ক। তাইতো স্টিভ ওয়াহ সেদিন হারের পরও বলেছিলেন, ‘এটাই আমার খেলা সেরা ম্যাচ। আমরা দেখা সেরা ইনিংস। ফলাফল টাই হলেই সুবিচার হতো।’
অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে একক আধিপত্যে, অতিমানবীয় ১৫৩ রানের ইনিংস খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১ উইকেটে জিতিয়েছিলেন লারা। মহাকাব্যিক ইনিংসটিকে বলা হয়, গ্রেটেস্ট অব অল টাইম।’ তাইতো লারাকে কেউ কেউ বলেছেন, অবিশ্বাস্য, কেউ বলছেন সুপারম্যান। কারো জন্য হয়েছেন প্রথম প্রেম!
স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৪৯০ রান করেছিল। জবাবে স্বাগতিকরা ৩২৯ রানের বেশি করতে পারেনি। এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করলেও সর্বকালের সেরা দুই বোলিং জুটি কোর্টনি ওয়ালশ আর কার্টলি অ্যামব্রোসের আগুনঝরা বোলিংয়ে মাত্র ১৪৬ রানে গুটিয়ে যায় অতিথিরা। লারার দলের টার্গেট ৩০৮ রান। হুট করেই ব্রিজটাউনের উইকেট হয়ে পড়ে বোলারদের স্বর্গ। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার ব্যাটিং ব্যর্থতায় স্বাগতিকরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোরবোর্ডে রান ১০৫, অর্ধেক ব্যাটসম্যান সাজঘরে। চার নম্বরে নামলেন লারা।
নেমেই একক আধিপত্য বিস্তার। কোনো কিছুর তয়োক্কা না করে ব্যাটিং করলেন আগ্রাসী মনোভাবে। পেসারদের কচুকাটা করলেন। স্পিনারদের এলোমেলো করলেন। চোখে চোখ রেখে ফিল্ডারদের যেন বলছিলেন, যাও বাউন্ডারি থেকে বল কুড়িয়ে আনো!
৩০৮ রানের সুবিশাল পাহাড়ে চড়ার অসাধ্য সাধন করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর লড়াই ছিল একার। সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন লেজের ব্যাটসম্যানদের। তবুও ভালো জিমি অ্যাডামস ১২৫ বল খেলে ১৭০ মিনিট টিকে ছিলেন। আর শেষ দিকে অ্যামব্রোস ছিলেন দুর্দান্ত। ৩৯ বল খেলেন। উইকেটে টিকে ছিলেন ৮২ মিনিট। সতীর্থদের শেষ অবদানটুকুই লারাকে বানিয়েছে কিংবদন্তি। অ্যামব্রোস যখন আউট হলেন তখনও লক্ষ্য ছুঁতে দরকার ছিল ৬ রান। লারার শেষ পার্টনার ওয়ালস।
পেস কিংবদন্তির ওপর ভরসা রাখা ছিল কঠিনতম সিদ্ধান্ত। কিন্তু ম্যাকগ্রার ইনসুইং ইয়র্কার যখন ওয়ালস ফিরিয়ে দেন তখন লারা বুঝতে পারেন আজ তাকে আর আটকানো যাবে না। পরের ওভারে গিলেস্পিকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে মহামানবের আসনে নিজেকে নিয়ে যান ক্রিকেটের বরপুত্র।
মাত্র ১ উইকেটে জয়। অথচ ওই অত্যল্প জয়েই লারা ফিরে পান নিজেকে। ওই সময়টাও ছিল বেশ কঠিন। বোর্ডের সঙ্গে বেতনভাতা নিয়ে বিতর্ক। তাঁর ব্যাটেও রান ছিল না। দল কিছুদিন আগে ৫-০ ব্যবধানে হেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। কাঁধে রাজ্যের বোঝা। ব্রিজটাউনে নামার আগে কিংসটনে ২১৩ করেছিলেন লারা। ওই ইনিংস দিয়ে পথ চলা শুরু। ব্রিজটাউনে ১৫৩ করে নিজের পূর্ণতা ফুটিয়ে তোলেন।
অথচ লারার ওই ১৫৩-র পর ক্রিকেট বিশ্ব কতো ধ্রুপদী ইনিংস-ই না দেখেছে! লারার নিজের ৪০০, বীরেন্দর শেবাগের ৩০৯, ভিভিএস লক্ষ্মণের ২৮১ কিংবা এখনও সজীব হয়ে থাকা কুশল পেরেরার ১৫৩ এবং বেন স্ট্রোকসের ১৩৫। কিন্তু লারা যেই মায়ার জালে আটকে রেখেছিলেন সেই বন্ধন থেকে বের হতে পারছে না রথী মহারথীরাও। আর ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে টিভি সেটের সামনে বসে এক কিশোর বলে উঠে, ‘লাভ ইউ লারা।’
১৫৩ রান, ২৫৬ বল, ৩৫৫ মিনিট, ১৯ চার ও ১ ছক্কা- সংখ্যা গুলো শুধু সংখ্যা নয়, লারার চিরগৌরবের বীরত্বগাথা।