ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় করোনার সংক্রমন থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় ও বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণে ১৩ লাখ টাকার খরচ দেখায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার রেইনা।
করোনার সুরক্ষা সামগ্রী কেনায় আখাউড়া উপজেলা পরিষদের তালিকা ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তরের তালিকার মধ্যে টাকার পরিমান ও সামগ্রী কেনার পরিমানের মধ্যে বেশ পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে।
এসব সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় বাবদ উপজেলা উন্নয়ন তহবিল থেকে ১২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা আক্তার রেইনার ভাষ্য, সব কিছু নিয়ম মেনে করা হয়েছে। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের এসব কেনার একটি ইস্টিমেটের কপি দেন। তবে এসব কেনার বিল ভাউচার দেখাতে ব্যর্থ হন ইউএনও।
পরে তিনি উপজেলা প্রকৌশল কার্যালয়ের সার্ভেয়ার জহুরুল ইসলামের মাধ্যমে ৩০ প্রকার সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ের একটি তালিকা পাঠান। যার সাথে আগে দেয়া ইস্টিমেটর কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
ক্রয় করা মালামালের উপজেলা পরিষদের তালিকা সূত্রে জানা গেছে, দেড় লাখ টাকায় পাঁচ হাজার ১০০টি মাস্ক, এক লাখ ৩৫ হাজার ৫০০টাকায় ৩ হাজার ৯৩০টি গ্লাভস, ২ লাখ ১০ হাজার টাকায় ৬০টি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫৫০টাকার মধ্যে ৯০টি চশমা, ৩০০ ক্যাপ, ১৬০ জোড়া সুকাভার, ১০০ মুখ কাভার, ২০ জোড়া রাবারের তৈরি বুটজুতা, সেনিটাইজার, ৩৩টি এপ্রোন, ৬টি রেইনকোট, ১০০ হ্যান্ডস্প্রে, এক হাজার ২০০ ভ্যাকিউম টিউব, এক হাজার ২০০ সপ স্টিক, চারটি থার্মোমিটার, ৫০টি ওটি গ্রাউন ও ৬টি স্প্রে মেশিন, ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩০৮ টাকায় ২৬টি বেসিন এবং সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট ও চার শতাংশ কর মিলিয়ে এসবে মোট খরচ দেখানো হয়েছে ১২ লাখ ৮৭ হাজার ৭২৫ দশমিক ২৩ টাকা। তবে ইস্টিমেটের সাথে এসব কেনার তালিকায় বিভিন্ন সামগ্রীর পরিমান ও টাকার পরিমানের কোনো মিল নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আখাউড়ায় উপজেলায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ বা সুশীল সমাজের কেউ স্বাস্থ্য সুরক্ষার এসব কোনো সরঞ্জাম পাননি। হিসাবের তালিকায় ২৬টি বেসিন নির্মাণের কথা উল্লেখ থাকলেও উপজেলায় ব্যবহার উপযোগী ১৫টি বেসিন পাওয়া গেছে। নিম্নমানের কাজের জন্য বাকি বেসিনগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
এদিকে ইস্টিমেটের নথিতে দেখা গেছে, ১৩ মার্চ করোনায় এসব সুরক্ষা সামগ্রী কেনার হিসাব (ইস্টিমেট) করা হয়। ওই বিলে ১৫ মার্চ ইউএনও, উপজেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ ও জরিপকারক (সার্ভেয়ার) জহুরুল ইসলাম স্বাক্ষর করেন। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাসেম ভূঁইয়া স্বাক্ষর করলেও কোনো তারিখ দেননি। তাদের স্বাক্ষরযুক্ত ওই ইস্টিমেটে এসব প্রকল্প প্রস্তুতির তারিখ উল্লেখ রয়েছে ২৭ মে। ২৬ মার্চ দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। তখনও আখাউড়ায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। জেলার আখাউড়ায় ৯ এপ্রিল প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। করোনার আগেই তিনি এসব প্রাক্কলন করেছেন।
এ ব্যাপারে আখাউড়া উপজেলা এলজিইডির সার্ভেয়ার জহুরুল ইসলাম বলেন, এত টাকার সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা হলো কিন্তু আমি নিজেই কিছু পাইনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, একই ভবনে থাকা সত্বেও তারা কোন সুরক্ষা সামগ্রী পাননি।
মনিয়ন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল ভূইয়া বলেন, আমাকে কিছু ব্লিচিং পাউডার দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আর অন্য কিছু পাইনি।
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন বলেন, আমাকে ১০০টি মাস্ক ও ২০ জোড়া গ্লাভস দিয়েছে। এছাড়া আর অন্য কিছু পায়নি।
আখাউড়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক আব্দুল মমিন বাবুল বলেন, করোনাকালীন সময়ে যুবলীগের পক্ষ থেকে মাস্ক, স্যানিটাইজার বিতরন করা হয়েছে। শ্রমিক সংকটে জমি থেকে কৃষকের ধান কেটে দিয়েছে। ইউএনও কোথায় এত টাকার মাস্ক, সেনিটাইজার, পিপিই বিতরণ করেছেন তা আমিই জানি না।
উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন বেগ শাপলু বলেন, করোনা সংক্রমনের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গুরত্বস্থানে জীবানুনাশক স্প্রে করেছে। মাস্ক বিতরণ করেছে। প্রশাসনকে কোথাও করোনা সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করতে দেখিনি। আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আমাকে কোনো সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, সুরক্ষা সামগ্রীর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাস্ক, পিপিসহ অন্যান্য সামগ্রী বেশি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে মাস্ক-স্যানিটাইজার, গ্লাভস দিয়েছেন। তাছাড়া সাধারন মানুষের মাঝে বিতরণ করেছেন।
এ ব্যাপারে আখাউড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাসেম ভূইয়া বলেন, আমি বলেছিলাম ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করতে। কিন্তু ইউএনও ইচ্ছেমতো এতগুলো টাকা খরচ করেছেন। বিল ভাউচার ঠিক না থাকায় প্রথমে আমি এই টাকা অনুমোদনে স্বাক্ষর করতে রাজি ছিলাম না। পরে চক্ষু লজ্জায় স্বাক্ষর করেছেন বলে জানান তিনি।