সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লাইলা কানিজ লাকী টাকা, পেশি শক্তি আর প্রভাবে নরসিংদীর রায়পুরায় নিজ নির্বাচনী এলাকায় রাতারাতি অলিখিত সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন। সাবেক শিক্ষিকার আড়ালে রাজনীতিকেই টাকা কামানোর হাতিয়ার বানিয়ে গড়ে তোলেছিলেন সাম্রাজ্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মো. মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লাইলা কানিজ লাকী গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ গড়েছেন লাইলা কানিজ। কোঠা বিরোধী ছাত্র আন্দলন চলাকালে ছাত্রদের উপর হামলা ও গুলির নির্দেশ দাতাসহ অর্থ সহযোগীতা দিতেন বলেও জানান এলাকাবাসী। আর সরকার পতনের পর গা ডাকা দিয়েছেন আলোচিত সাবেক উপজেলা চয়োরম্যান লাইলা কানিজ লাকী। নাম প্রকাশে অনি”ছক একাধিক ব্যক্তি জানায়, সাবেক এমপি রাজি উদ্দিন আহম্মেদ রাজু বর্তমানে তার সাথেই রয়েছেন। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লাকী একজন সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হয়ে কীভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। লাকী ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। একই সঙ্গে রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ২০২৩ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান মারা গেলে স্বে”ছায় চাকরি ছেড়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন এবং অবৈধ টাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় চেয়ারম্যান হন লাইলা কানিজ লাকী। জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন তিনি। তার নির্বাচনী হলফনামা থেকে জানা গেছে, বাৎসরিক আয় বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানি বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫, ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫লাখ টাকা। তার কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ, তার অকৃষিজমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ।এদিকে, মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অব¯ি’ত মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির কয়েক কোটি টাকায় নির্মিত আধুনিক ¯’াপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়িটির ভেতরে রাজকীয় সব আসবাবপত্র ও দামি জিনিসপত্র রয়েছে। লাকির ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টে গিয়ে দেখা গেছে, দেড় একরের বেশি আয়তনজুড়ে পার্কটির অব¯’ান। ভেতরে রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক কটেজ। নির্ধারিত টাকায় এ কটেজে রাত্রিযাপন করা যায়। এ ছাড়া পার্কে রয়েছে বিভিন্ন বয়সীদের জন্য বেশকিছু রাইড। পুরো পার্কজুড়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও ¯’াপনা এবং বিশাল আয়তনের একটি লেক। ¯’ানীয়দের কাছে লাকীর পার্ক বলে প্রচার আছে এবং পার্কটি প্রতিরাতে পাটি আর নেশার আসরসহ নারীদের নিয়ে আমোদ ফুর্তিতে মেতে উঠতেন বালেও জানান এলাকাবাসী। রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতি উরের নিকট বিয়ের পর থেকেই বাড়তে থাকে সম্পদের পাহাড়। শুরু হয় বৈধ অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের নেশা। সাবেক মন্ত্রী এমপিদের সাথে মিলে শেয়ার বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর এসব দেখাশুনা করতে লাকী নিজ এলাকাসহ নরসিংদতে গড়ে তুলেছেন বিশাল এক বাহিনী। যার কারনে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হয়েছিলেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছক এলাকাবাসী জানায়, তাঁর তৈরি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভূমি দখল,শেয়ার বাজার লুট সহ রাজস্ব কর্মকর্তার মতিউর রহমান ব্যবসায়ীদের জিম্মী করে অবৈধ ভাবে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয় সরকারি সব দপ্তরের নির্মাণকাজের নিয়ন্তনও ছিল তার হাতে। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্বাচনী এলাকা ঘুরে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই জেলায় সড়ক, এলজিইডি, কৃষি জমি দখল, বিভিন্ন নিয়োগ বাণিজ্যসহ মেঘনা নদী থেকে বালু ব্যবসা ছিল তাঁর দখলে। পরিবারের সদস্যরা তাঁর ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে রায়পুরাসহ পুরো জেলায় গড়ে তোলেন সাম্রাজ্য। যার ধাপে ধাপে ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি ও দখল বাণিজ্য। শুধু দুর্নীতি আর অবৈধ সম্পদের পাহাড়ই গড়েননি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দলনে ছাত্রদের উপর হামলার নির্দেশ দাতা, অর্থ দাতা ছিলেন তিনি। বর্তমানে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লাকী ও তার পরিবারের সদস্যরা গা ডাকা দিয়েছেন। নরসিংদীতে অপরাধ সংঘটনেও সমান সিদ্ধন্তে ছিলেন তিনি। কয়েক বছরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লাকী ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বেড়েছে কয়েক হাজার গুন। এসব বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা অনুসন্ধান করছেন বলে জানান এলাকাবাসী। আর তাদের সকল সম্পাদ বাজেয়াপ্ত করে সরকারী ভাবে রিসিবার নিয়োগ করার ঘোষনা দিলেও এখনো উক্ত সম্পদ তাদের লোকজনই দেখা শুনা করে। আর সাবেক স্বৈরাচার সরকার শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর লাকীর বিষয়টি দামাচাপা পড়ে যায়। যার ফলে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লাকী রয়েছেন ধরাছোয়ার বাইরে। আর বিষয়টি আমলে নিয়ে বিচারের দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী। আর এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসনের কেউ কথাবলতে রাজি হয়নি।