সিরাজগঞ্জ যমুনা নদীবেষ্টিত জেলা। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর বুকে চর জেগে ওঠে। বন্যায় পলি মাটি জমে উর্বর আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে চরভূমি। এসব চরে আবাদযোগ্য জমি ৪২ হাজার ৭০০ হেক্টর। এর মধ্যে ৩৮ হাজার ২৫০ হেক্টরে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ হচ্ছে। বাদাম, মরিচ, ভুট্টাসহ কয়েকটি ফসলের প্রায় ৬০ শতাংশ আবাদ হচ্ছে চরে। এছাড়া প্রতি বছর জেলায় গড়ে ধান আবাদ হয় ২ লাখ ৩৮ হাজার ১০৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে চরভূমিতে ২৬ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে কাজিপুর উপজেলার ৬টি, সদরের ২টি, বেলকুচির ৩টি, শাহজাদপুরে ৩টি এবং চৌহালীর ৮টি ইউনিয়ন যমুনাবেষ্টিত। দেড় দশক আগেও ব্রহ্মপুত্রের শাখা যমুনার ভাঙনে শত শত কৃষক পরিবার ভূমিহীন হয়েছে। নদীর তীর রক্ষা প্রকল্পের সুবিধা এবং যমুনার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় চর জেগে উঠেছে। একসময় এসব চরে ফসল তো দূরের কথা, ঘাসও হতো না। বন্যায় পলি মাটি জমে চরভূমি এখন আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর ৩-৬ মাস চরভূমি পানিতে ডুবে থাকার কারণে পলি মাটি সমৃদ্ধ হয়। এসব চরে গম, কাউন, ভুট্টা, বাদাম, মিষ্টি আলু, তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, গাজর, মরিচ, হলুদ, শসা, শিম, কুমড়া, ধান এবং বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় কৃষক পরিবার রয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কৃষক পরিবার চরাঞ্চলে আবাদের সঙ্গে যুক্ত। চরাঞ্চলে আবাদযোগ্য জমি রয়েছে ৪২ হাজার ৭০০ হেক্টর। এর মধ্যে ৩৮ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ হচ্ছে। জেলায় প্রতি বছর গড়ে বাদাম চাষ হয় ৫ হাজার ১৬০ হেক্টরে, মসুর ডাল ৪ হাজার ২৬০, খেসারি ডাল ৬ হাজার ৯৪৭, মরিচ ১ হাজার ৬৩৬, ভুট্টা ১২ হাজার ৩৩৫ ও সবজি চাষ হয় ১৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে চরভূমিতে বাদাম ৫ হাজার ৫০ হেক্টর, মসুর ডাল ৩ হাজার ৯০০, খেসারি ডাল ২ হাজার ৯০০, মরিচ ১ হাজার ২৫০, ভুট্টা ৭ হাজার ৫৫০ এবং সবজি চাষ হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এছাড়া বোরো এবং রোপা আমন ধান মিলে প্রতি বছর জেলায় গড়ে আবাদ হচ্ছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ১০৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে চরাঞ্চলে উৎপাদন হচ্ছে ১১ শতাংশ। অর্থাৎ ২৬ হাজার ২০০ হেক্টর চরভূমিতে বিভিন্ন জাতের ধানের আবাদ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, ‘জেলার কৃষিপণ্যের বড় অংশ এখন আবাদ হচ্ছে চরভূমিতে। বাদাম, মরিচ, ভুট্টাসহ কয়েকটি ফসলের প্রায় ৬০ শতাংশ আবাদ হচ্ছে চরে। সেই চিন্তা থেকে চরে উন্নত জাতের ফসলের প্লট প্রদর্শনী করা হচ্ছে। কৃষকের বিভিন্ন ফসল এবং আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। কৃষি প্রণোদনাও পাচ্ছে তারা।’ ইরিগেশন সাপোর্ট প্রজেক্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড নিয়ারইস্টের (ইসপান) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের প্রধান ৫টি নদীতে চরের আয়তন প্রায় ১ হাজার ৭২২ দশমিক ৮৯ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের মোট জমির ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। ৯৮৭ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটার চরভূমি রয়েছে উত্তরাঞ্চলের ব্রক্ষপুত্র ও যমুনা অববাহিকায়। চর এলাকায় বাস করছে প্রায় সাত লাখ মানুষ। এর মধ্যে যমুনার চর এলাকায় প্রায় চার লাখ বাস করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ এবং চরে আবাদযোগ্য ফসল ও চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের আরো সচেতন করা গেলে উৎপাদন বাড়বে। এর ফলে চরের মানুষের আরো সচ্ছলতা আসবে। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নিজস্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চরভূমি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলাচ্ছেন কৃষক, যা জেলা তথা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। চরের উৎপাদন ব্যবস্থা মজবুত এবং দীর্ঘ স্থায়ী করতে হলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ নির্বাচন করতে হবে। পাশাপাশি মাটির গুণাগুণ বিচার করে ফসল আবাদেও জন্য নির্ধারণ করতে হবে। চরভূমিতে প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থাও থাকা জরুরি। উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে চরের কৃষকদের মৌসুমি, বার্ষিক বা তার অধিক সময়ের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা ও প্রণোদনা দিতে হবে। অর্থাৎ চরের জমিকে পরিকল্পনামাফিক আবাদের আওতায় আনতে সময় উপযোগী বাস্তব পরিকল্পনা জরুরি।’