আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে শুরু হচ্ছে দুই দিনব্যাপী জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। যেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও শক্তিধর দেশগুলোর নেতারা অংশ নেবেন। সেখানে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে এক মঞ্চে বসবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে এবারের জি-২০ সম্মেলনে আলাদা দৃষ্টি রাখছে বাংলাদেশ।
ধারণা করা হচ্ছে-বাংলাদেশের উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বিশ্বনেতাদের বিশেষ বার্তা দিতে পারে ভারত। নির্বাচন কেন্দ্র করে সরকারের ওপর যেন কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করা না হয়।
আগামীকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠক থেকে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটসহ নানা বিষয়ে বিশেষ বার্তা আসতে পারে বলে মনে করছেন এক শ্রেণির রাজনৈতিক বিশ্লেষক। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা নাও পারে। তাদের ভাষ্যমতে, যে ইস্যুতে সম্মেলন হচ্ছে-সেই বিষয়েই শুধু আলোচনা হবে।
nagad
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ‘ভারত মণ্ডপ’ আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে শীর্ষ নেতাদের সম্মেলনের সাইড লাইনে আগামী শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক সময় ১৩টা ৩৫ মিনিটে রয়েল হাইনেস ক্রাউন প্রিন্স এবং সৌদি আরবের প্রধানমন্ত্রী, ১৪টা ৩০ মিনিটে আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং ১৫টায় কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই সরব যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কিছু দেশ। দৃশ্যমান দেশগুলোর কূটনৈতিক তৎপরতা। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বাংলাদেশের উপর দেয়া হয়েছে ভিসানীতি। এমন অবস্থায় আসন্ন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব তুলে ধরবে ভারত। সম্মেলনে বাংলাদেশকে অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যদিয়ে এই গুরুত্ব এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মানবকণ্ঠকে বলেন, এবারের জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়েছে। এই সম্মেলনের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচনের এজেন্ডার কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে যে জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে- তা নানা কারণে হচ্ছে। কিন্তু এই ধরনের সম্মেলনগুলোতে এসব বিষয় নিয়ে কখনোই আলোচনা হয় না বলে আমরা বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, তবে আগের দিন বাংলাদেশ-ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মানবকণ্ঠকে বলেন, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অনেকের থেকে অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয় না জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যু নিয়ে কোনো কথা হবে। যে ইস্যুতে সম্মেলন হচ্ছে। সেই বিষয়েই শুধু আলোচনা হবে বলে আমাদের ধারণা। শুধু যারা ক্ষমতায় থাকার জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে-তারাই এই বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে আমরা মনে করি না। তিনি বলেন, তবে শেখ হাসিনা-মোদি বৈঠকে নানা বিষয় আলোচনা হতে পারে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিগুলোর জোট জি-২০ এর সদস্য নয় বাংলাদেশ। জোটের বর্তমান সভাপতি ভারত ৯টি দেশকে বিশেষ অতিথি হিসেবে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এমন এক সময় বাংলাদেশ এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছে- যখন বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে সরব ভ‚মিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কিছু দেশ। প্রতিনিয়ত চালাচ্ছে কূটনৈতিক তৎপরতা।
এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ৮ তারিখ শুক্রবার সন্ধ্যার সময় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের দ্বিপাক্ষিক অনেক ইস্যু রয়েছে। সবগুলো নিয়ে আলাপ হবে। আমাদের কানেক্টিভিটি ইস্যু আছে, তিস্তার পানির বিষয়ে কথা বলব। এরপর এনার্জি সিকিউরিটি, ফুড সিকিউরিটি নিয়ে আলাপ হবে।
মাসুদ বিন মোমেন আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে এখন প্রচুর প্রজেক্টও রয়েছে, সেগুলোর অগ্রগতি নিয়ে আলাপ হবে। পুরো দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলাপ করার সুযোগ হবে না। তারপরও যত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে সেগুলো নিয়ে আলাপ হবে। নির্বাচনের আগে ভারতের সরকার প্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক নির্বাচনের কারণে আলাদা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ভারতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ), কলকাতার সহযোগী ফেলো সুহাসিনী বোসের মতে, ভারত জি২০-এ তার বৈশ্বিক এজেন্ডা রূপায়ণের চেষ্টা করছে। এজেন্ডাগুলোর অনেকগুলোই তার প্রতিবেশী অঞ্চলে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের সমর্থন প্রয়োজন। বাংলাদেশের গুরুত্বের কারণ হিসেবে তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারী, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের গুরুত্ব, ভারতের ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির কথা উলেখ করেছেন। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবিলা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সাইবার নিরাপত্তা এবং আরও জোরালো বহুপাক্ষিকতা গড়তেও ভারতের কাছে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব আছে।
বাংলাদেশ বিশ্বে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি), জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর কণ্ঠস্বর। জি-২০ সম্মেলন সামনে রেখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর কণ্ঠস্বর হতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ নয়াদিলিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে জলবায়ু, খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা, অভিবাসী ইস্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবে। আঞ্চলিক সংযোগ, সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার ওপরও বাংলাদেশ জোর দেবে। বাংলাদেশ বিশ্বশান্তির কথা বলবে।
ছয় এজেন্ডা: জি-২০-এর সভাপতি হিসেবে ভারত এবারের শীর্ষ সম্মেলনের জন্য ছয়টি এজেন্ডা সামনে এনেছে। এগুলো হলো সবুজ উন্নয়ন, জলবায়ু অর্থ ও জীবন, ত্বরান্বিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি, এসডিজিতে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা, প্রযুক্তিগত রূপান্তর ও ডিজিটাল সরকারি অবকাঠামো, ২১ শতকের জন্য বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান এবং নারীর নেতৃত্বে উন্নয়ন। এ ছাড়া এবার জি-২০-এ আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হতে পারে।
জি-২০ কী: জি-২০ হলো একটি কৌশলগত বহুপাক্ষিক সংগঠন, যা বিশ্বের প্রধান উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো নিয়ে গঠিত। জি-২০-র পূর্ণরূপ হলো গ্রুপ অব টোয়েন্টি। যার সদস্য ১৯টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। ওই সংকট থেকে বিশ্বনেতারা উপলব্ধি করেন যে, এ ধরনের সংকট আর একটি দেশের সীমানার মধ্যে আটকে রাখা যাবে না এবং সংকট মোকাবিলায় আরও উন্নত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
সেই উপলব্ধি থেকে বিশ্বের প্রভাবশালী ১৯টি দেশ ও একটি রাজনৈতিক সংগঠন মিলে একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলে, যা বর্তমানে জি-২০ নামে পরিচিত। বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮০ শতাংশই জি-২০ জোটের দখলে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে এই জোটের দেশগুলো।
জি-২০ জোটের বর্তমান সদস্যগুলো হচ্ছে: আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জি-২০ গঠনের পর শুরুর বছরগুলোতে শুধু সদস্যদেশগুলোর অর্থ বিভাগের প্রধানরাই সম্মেলনে যোগ দিতেন। তবে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর সিদ্ধান্ত হয়, জোটের সদস্যদেশগুলোর নেতারা প্রতিবছর শীর্ষ সম্মেলনে বসবেন।
যারা যোগ দিচ্ছেন সম্মেলনে : জোটের সব সদস্যই এবারের সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব শ্রম সংস্থা, ফিন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি বোর্ড, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানরাও অংশ নেবেন এই শীর্ষ সম্মেলনে।
পাশাপাশি অংশ নেবেন আফ্রিকান ইউনিয়ন, আশিয়ান, আফ্রিকান ইউনিয়ন ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর প্রধানরাও। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সৌর জোট, কোয়ালিশন ফর ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এই সংস্থাগুলোকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না। তার জায়গায় নয়াদিল্লি আসছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। আসছেন না চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও। তার প্রতিনিধিত্ব করবেন চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং।
আলোচনায় যা যা থাকছে: জি-২০-এর এবারের সম্মেলনের সভাপতিত্ব করছে ভারত। এটা জোটের ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন। এ বছর সম্মেলনে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুগুলো হলো- বহুপক্ষীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও ঋণের ব্যবস্থা করা, আন্তর্জাতিক ঋণকাঠামোর সংস্কার, ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে নীতিমালা তৈরি এবং খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভ‚রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব। তবে এ নিয়ে এখনো কোনো যৌথ বিবৃতি দিতে পারেনি জোটের দেশগুলো। কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানের কারণে গভীরভাবে বিভক্ত তারা। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর জন্য মস্কোকে দোষারোপ করার বিরুদ্ধে রাশিয়া ও চীন। অন্যদিকে যুদ্ধের জন্য মস্কোর প্রতি কঠোর নিন্দা জানানোকে যৌথ বিবৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও কানাডাসহ পশ্চিমা বিশ্ব।
এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য: ভারতে অনুষ্ঠেয় এবারের জি-২০ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ‘বাসুদেইভা কুটুমবাকাম’। সংস্কৃত এ শব্দগুচ্ছের অর্থ ‘পুরো বিশ্ব একটি পরিবার’। চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর ব্রাজিলের কাছে জি-২০-এর সভাপতিত্ব হস্তান্তর করবে ভারত। সেই হিসাবে আগামী বছর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ব্রাজিলে।