বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সমাবর্তন আজ সোমবার ১৩ মার্চ, ২০২৩ইং তারিখে বিকাল ৪টায় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভাপতিত্ব করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর জনাব মোঃ আবদুল হামিদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথির হিসেবে বক্তব্য রাখেন মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জনাব জাহিদ মালেক, এমপি। ভারতের বিহারে ইউনিভার্সিটি সার্ভিস কমিশনের সম্মানিত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাজবর্ধন আজাদ সমাবর্তন বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। গুরুত্বপূর্ণ এই সমাবর্তনে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ মনিরুজ্জামান খান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান প্রমুখসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্যবৃন্দ, সম্মানিত ডিনবৃন্দ, বিভাগীয় চেয়ারম্যানবৃন্দ, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, শিক্ষকবৃন্দ, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চিকিৎসকবৃন্দ, সেবিকাবৃন্দ, অফিস প্রধানগণ ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদের মাননীয় সদস্যবৃন্দ, মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, সাংবাদিকবৃন্দ, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর জনাব মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সাথে গবেষণা এবং অধিকতর উন্নত চিকিৎসা প্রদান করার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্প্রতি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল চালু করায় দেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে না যেয়ে কম খরচে দেশেই উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, মানবসেবা একটি স্বর্গীয় গুণ। রোগাক্রান্ত মানুষ সৃষ্টিকর্তার পর একজন ডাক্তার ও নার্সের ওপর ভরসা রাখেন। আপনাদের ভালো ব্যবহার ও চিকিৎসা যে কোনো রোগীর পরম কাম্য। আপনারা উদার মন নিয়ে জনসাধারণের মাঝে ভালো ডাক্তারের পাশাপাশি বড়ো মানুষ হিসেবেও বিবেচিত হবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে গবেষণার বিকল্প নেই, অথচ আমাদের চিকিৎসা শিক্ষায় গবেষণার পরিমাণ খুবই কম। আমাদের দেশের রোগব্যাধির ধরণ উন্নত ও পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে ভিন্ন। যে কারণে আমাদের নিজস্ব গবেষণাকর্মই শুধু পারবে এদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ রোগসমুহের কার্যকর ও সুলভ চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবন করে এদেশের রোগীদের সত্যিকারের সমাধানটি সহজলভ্য করতে। তাই আমি আপনাদের গবেষণায় আরো বেশি নিয়োজিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। মাননীয় চ্যান্সেলর বলেন, রোগী আছে বলেই চিকিৎসা পেশা আছে। তাই যাদের কারণে আপনাদের রুটিরুজি তাদের প্রতি আপনাদের আরো যত্নবান হওয়া উচিত। বড়ো ডাক্তার হয়ে অপ্রয়োজনীয় বড়ো বড়ো টেস্ট দিয়ে রোগীদের হয়রানি করবেন না। কিছুসংখ্যক অসাধু ও প্রতারক চিকিৎসকদের জন্য যাতে গোটা চিকিৎসক সমাজের সুনাম ক্ষুন্ন না হয় সেদিকেও সচেতন থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, হাসপাতালে একজন রোগী সার্বক্ষণিক সেবা ও সহচার্য পায় নার্সদের কাছ থেকে। একজন নার্সের সুন্দর ব্যবহার ও উৎসাহব্যাঞ্জক কথা রোগীর হাসপাতালে অবস্থানকে আরামদায়ক করে ও আরোগ্য ত্বরান্বিত করে। তাই নার্সদের রোগীর সেবায় আরো আন্তরিক হতে হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, আমাদের চিকিৎসকরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ করে করোনা মহামারিকালে সেবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা খুবই প্রশংসনীয় ও অতুলনীয়। অনেক চিকিৎসককে রোগীর সেবা দিতে গিয়ে প্রাণও দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও মনে রাখতে হবে ডাক্তারগণ আল্লাহ বা ভগবান নন। তারাও মানুষ। কেবল চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন। তাই রোগীর কিছু হলেই ডাক্তারদের দায়ী করবেন আর হাসপাতাল ভাঙচুর করবেন এটাও কাম্য নয়। তাই ডাক্তার, রোগী ও আত্মীয়স্বজনদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। এমন অবস্থা কারোরই কাম্যই নয় যার ফলে সাধারণ মানুষ ও রোগীরা অসহনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। সমাবর্তন বক্তা ভারতের বিহারে ইউনিভার্সিটি সার্ভিস কমিশনের সম্মানিত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাজবর্ধন আজাদ ‘দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে চিকিৎসা শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার আন্তঃবিবর্তন- বিবর্তন, চ্যালেঞ্জ এবং এগিয়ে যাওয়ার পথ’ শীর্ষক বক্তব্য রাখেন। চিকিৎসা শিক্ষায় চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলেন, দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের চ্যালেঞ্জটি বিশাল এবং সর্বোত্তম উপায় হল প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করা। সংস্কৃতি, ভাষা এবং ভূগোলের বৈচিত্র্য এই অঞ্চলে চিকিৎসা শিক্ষা এবং মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। আরেকটি দিক হল নিম্ন মধ্যম এবং ধনী সম্প্রদায়ের বিস্তৃত বিভাজন এবং যারা বস্তি বা গ্রামে বসবাস করে তারা উচ্ছেদ এবং স্থানান্তরের ক্রমাগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাদের একটি অবিচ্ছিন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করা সমস্যাযুক্ত হতে পারে। একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী পদক্ষেপ হবে দরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা। লিঙ্গ বৈষম্য এবং অসমতার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা আমাদের সংস্কৃতি ও অঞ্চলের অন্তর্নিহিত। আলমামাতা একটি ঘোষণা অনুসারে সকলের জন্য স্বাস্থ্য প্রদানের ক্ষেত্রে দূরবর্তী অঞ্চল এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সাথে নাগালযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা অন্যান্য প্রধান বাধা। এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া বৈপরীত্যের বিশ্ব। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও, এই অঞ্চলে এখনও দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যের চাহিদাও অনেক বেশি। সম্প্রদায়-ভিত্তিক চিকিৎসা শিক্ষা আংশিকভাবে এই চাহিদাগুলিকে সমাধান করতে পারে এবং বেশ কয়েকটি সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে কোভিডের পরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে গুরুতর বায়ু দূষণ কোভিড-পরবর্তী জটিলতার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। মেডিকেল ছাত্রদের স্বাস্থ্যের উপর দূষণের প্রভাব এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব মোকাবেলার পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে শেখানো উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০৫টি পোষ্টগ্রাজুয়েট কোর্স পরিচালনা করা হচ্ছে অন্যান্য ৪১টি মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে- এর মধ্যে ৬২টি রেসিডেন্সী কোর্স রয়েছে। চালু হয়েছে এমএসসি নার্সিং কোর্স। প্রতিদিন বহির্বিভাগে প্রায় ৮০০০ থেকে ৯০০০ রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করে সন্তুষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। ইতোমধ্যেই চালু করেছি ১৫টি ডিভিশন, খোলা হয়েছে নতুন ৭টি বিভাগ এবং ডেন্টালের ৫টি বেসিক কোর্স। দীর্ঘ ২৪ পর ফরেনসিক মেডিসন বিভাগ চালু হয়েছে।জেনোম সিকোয়েন্সিং, এন্টিবডি সেন্সিটিবিটিসহ বেশকিছু গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। বাংলাদেশ ও কোরিয়া সরকারের যৌথ অর্থায়নে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল চালু করা হয়েছে। ফলে দেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে না গিয়ে কম খরচে উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া দেশে প্রথমবারের মত ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। লিভারসহ অন্যান্য অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট কার্যক্রমও সমন্তরালভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফান্ড ৪ কোটি থেকে বৃদ্ধি করে ২২ কোটিতে উন্নীত করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১০০ কোটি টাকার সমন্বিত গবেষণা প্রকল্প থেকে আমরা সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকা গবেষণা খাতে বরাদ্দ পেয়েছি। এ পর্যন্ত ২৪ জন পিএইচডিতে ইনরোলড হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন পিএইচডি অর্জন করেছে। মাননীয় উপাচার্য আরো বলেন, বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য যা যা করা দরকার তার সবকিছুই করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়কে বিশে^র বুকে একটা রোল মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করব এই হলো চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপাচার্য হিসেবে আমার অঙ্গীকার। এদিকে সমাবর্তন উপলক্ষে মাননীয় চ্যন্সেলর ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মোঃ আবদুল হামিদ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর উচ্চতর শিক্ষা প্রদান ও গবেষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন নতুন গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং তা জনগণের স্বাস্থ্য সেবায় প্রয়োগ ঘটাতে দেশে চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে আরও সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। আমি আশা করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে আরো উদ্যোগী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। বাণীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের মেডিক্যাল উচ্চ শিক্ষার বিকাশে আমাদের সরকার ১৯৯৮ সালে দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠালগ্ন এই বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল উচ্চ শিক্ষার প্রসার ও বিকাশ, স্বাস্থ্যখাতে উচ্চতর গবেষণা এবং বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আজ দেশের চিকিৎসা জগতে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে পরিণত হয়েছে। এবারের সমাবর্তনে সাড়ে তিন হাজার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চিকিৎসক, সেবিকাবৃন্দ অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মেডিসিন অনুষদে প্রায় আট শত জন, সার্জারি অনুষদে প্রায় এক হাজার চারশত জন, শিশু অনুষদে প্রায় তিন শত জন , বেসিক সাইন্স ও প্যারাক্লিনিক্যাল অনুষদে পাঁচ শতাধিক জন, প্রিভেনটিভ এন্ড সোস্যাল মেডিসিন অনুষদে প্রায় তিন শত জন, ডেন্টাল অনুষদে শতাধিক স্নাতকোত্তর চিকিৎসকবৃন্দ এবং নার্সিং অনুষদে শতাধিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সেবিকাবৃন্দ । এই সমাবর্তনে ৩৫ জন মেধাবী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চিকিৎসক, সেবিকাবৃন্দকে চ্যান্সেলর কর্তৃক স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়।