চার বছর আগে দেশীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও ফিরিয়ে আনার উদ্দ্যোগের অংশ হিসাবে সরকার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএলআরআই) এর তত্ত্বাবধানে ‘ব্ল্যাকবেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন গবেষণা প্রকল্প’ চালু করলেও প্রকল্পের সুফল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। প্রকল্পের তালিকাভুক্ত খামারিদের ভর্তুকি মূল্যে ছাগী ও বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করার কথা থাকলেও খামারিরা তা পাচ্ছে না। আবার ছাগী দেওয়ার জন্য ২৫০০ টাকা নিয়েও ছাগল দেয়নি। বরং পরে সেই টাকা ফেরৎ দিয়েছে। খামারিদের সেই সরকারি ছাগী কর্তৃপক্ষ বাইরে বিক্রি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ।মেহেরপুর সহ দেশের নির্দিষ্ট সাতটি উপজেলাতে এই গবেষণা প্রকল্প চলমান। তবে মেহেরপুর সদর উপজেলার আশরাফপুর গ্রামে ৩০ জন খামারি নিয়ে চলমান এই গবেষণা প্রকল্পে কোন ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে গবেষণামূলক কার্যক্রমের কথা কেউ স্বীকার করেনি। বরং খামারিদের অভিযোগ কর্তৃপক্ষ টাকা নিয়েও তাদের দেয়নি ব্ল্যাকবেঙ্গল ছাগী। এমনকি খামারিরা জানে না প্রকল্পের সুবিধাভোগী হিসাবে তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা কি। সরেজমিনে জানা গেল গত চার বছরে খামারিরা মত্র তিনবার সামান্য কিছু ছাগলের খাবার পেয়েছে, এর মধ্যে একবার পেয়েছে শুধুমাত্র ধানের তুষ। খামারিদের বলা হয়েছে, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের মাধ্যমে আবেদন করে সরকারি ছাগল খামার থেকে পাঠা ও ছাগী কিনে নিতে। রিসার্চ এসোসিয়েটের বিরুদ্ধে প্রকল্প থেকে খামারীদের জন্য বরাদ্দকৃত ওজন মাপার স্কেল, ভ্যাকসিন, ঔষধ ও পাঠা বাইরে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ ও প্রমাণ থাকলেও অদৃশ্য কারণে নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। ২০০৭ সালে এফএও বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপরে গবেষণা চালিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় জাত ব্লাকবেঙ্গলকে বিশ্বসেরা ৫টি জাতের মধ্যে একটি বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। অথচ- প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিএলআরআই এর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব প্রাপ্তদের দূর্ণীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শেষে মেহেরপুরে ব্লাকবেঙ্গল ছাগল সংরক্ষণের পরিবর্তে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। বর্তমানে এই অঞ্চলে সরকারি ছাগল খামার ছাড়া আসল ব্লাকবেঙ্গল ছাগল আর চোখে পড়েনা। কর্মকর্তারা এখন কলো রঙের যে কোন ছাগলকেই ব্লাকবেঙ্গল বলে চালিয়ে দিতে চায়। অথচ ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত কিছু স্বকীয়তা রয়েছে। যেমন কান ছোট ও খাড়া, খাটো পা, বুকের বেড়, পা ও মাথার সর্বোচ্চ উচ্চতা ইত্যাদি। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক এমএএম ইয়াহিয়া খন্দকার জানান, ‘ ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের গায়ের রং মূলত কুচকুচে কালো আকারে বেঁটে কিন্তু শরীরের কাঠামো শক্তপোক্ত ও পেশী- বহুল। এর গায়ের লোম খাটো এবং শিং ছোট হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ছাগল বা পাঠার ওজন হয় ২২ থেকে ৩০ কেজি, ছাগীর ওজন ২০ থেকে ২৫ কেজি হয়।’ আশরাফপুর গ্রামের খামারি জাহিদ বলেন, ‘সরকারিভাবে আমাকে ২টা পাঠা দেওয়া হয়েছিল। বিএলআরআই প্রকল্পের রিসার্চ এসোসিয়েট মোস্তাফিজুর রহমান মুন্না আমার বাড়িতে এসে যশোর অফিসে পাঠানোর জন্য পাঠা দুটি নিয়ে গেছে। ছাগী দেবার জন্য ২০০০ হাজার টাকা নিয়ে দীর্ঘদিন পর ছাগী না দিয়ে টাকা ফেরৎ দিয়েছে।’ আরেক খামারি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘একই বাড়ির একাধিক সদস্য পৃথকভাবে খামারি হিসেবে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নানা সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। অথচ আমি গ্রামের সব থেকে বড় খামারী হয়েও বঞ্চিত। যেমন ওজন মাপার স্কেল পাইনি। কোন পাঠা পাইনি। এমনকি ব্লাকবেঙ্গল ছাগী দেওয়ার কথা বলে নেওয়া ২৫০০ টাকা দুই মাস পর ফেরত দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে গেছে রিসার্চ এসোসিয়েট। কিন্তু কেন আজ অবধি জানতে পারিনি।’ আশরাফপুর গ্রামে প্রকল্প অধিভুক্ত খামারীদের মুখপাত্র চামেলি খাতুন প্রথমে কিছু বলতে রাজি না হলেও পরে কথা প্রসঙ্গে রিসার্চ এসোসিয়েট মোস্তাফিজুর রহমান মুন্নার বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন, যেমন খামারিদের নামে ভর্তুকি মূল্যে সরকারি ছাগল খামার থেকে ছাগল কিনে বাজারে বিক্রি করে দেওয়া। মাঠ দিবস ও খামারি প্রশিক্ষণে আর্থিক অনিয়ম। বিনামূল্যে বিতরণকৃত ভ্যাকসিন প্রাণীদেহে প্রয়োগের পর টাকা নেওয়া। ৩০ জন খামারির জন্য ওয়েট স্কেল বরাদ্দ থাকলেও মাত্র ৯ জনকে সরবরাহ করা ইত্যাদি। এ বিষয়ে মেহেরপুর সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে কর্মরত রিসার্চ এসোসিয়েট মোস্তাফিজুর রহমান মুন্না কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রকল্পের পিডি সাদেক আহমেদ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সাতটি নির্দিষ্ট উপজেলাতে তাদের এই গবেষণা প্রকল্প চলমান। তবে প্রকল্পের বাজেট এবং খামারিদের সুযোগ-সুবিধা ও বরাদ্দ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে এ ধরনের কোন তথ্য দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে।’ এক সময় মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুচ্ছিা জেলা ব্লাকবেঙ্গল ছাগল পালনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু ব্লাকবেঙ্গল ছাগলের দু’দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এই অঞ্চলের ব্লাকবেঙ্গল ছাগল বিলুপ্ত কেন জিজ্ঞাসা করলে মেহেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান বলেন, ‘এখানে কোন ধরনের দুর্নীতি হয়নি। দেশ আধুনিক হয়েছে। সবাই চায় ছাগল থেকে অতিরিক্ত মাংস উৎপাদন করতে। তাই ব্লাকবেঙ্গল পালনে খামারিরা আগ্রহ হারিয়েছে।’