গণসমাবেশ ঘিরে সিলেটে বিএনপিতে ছিল উচ্ছ্বাস। অনেকটা বাধাহীনভাবে চলছিল প্রচার-প্রচারণা ও প্রস্তুতি। দেশের অন্যান্য বিভাগে গণসমাবেশের আগে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হলেও সিলেটে এর ব্যতিক্রম আশা করছিলেন দলের নেতারা। কিন্তু হঠাৎ করেই পাল্টে যেতে শুরু করেছে চিত্র।
বুধবার বাস মালিকরা শনিবার গণসমাবেশের দিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ধর্মঘট ডেকেছিলেন। তখনো অন্যান্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ছিলেন ধর্মঘটের বিপক্ষে।
কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে সভা করে ‘সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের’ পক্ষ থেকে সমাবেশের দিন সবধরণের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। এছাড়া বৃহস্পতিবার নগরীতে কয়েকশ’ মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন করেছে ছাত্রলীগ।
সমাবেশস্থলের পাশে গিয়ে তারা ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে সমাবেশ করেছেন।
এছাড়া বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বিএনপির প্রস্তুতি সভায় পুলিশের বাধা, হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটছে। তাই শেষ মুহূর্তে এসে বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বেড়ে গেছে। আর পুলিশ বলছে, সমাবেশ ঘিরে কেউ কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা কিংবা নাশকতার চেষ্টা করলে তাদেরকে শক্ত হাতে দমন করবে।
শনিবার বেলা ২টায় সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সমাবেশস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পক্ষ থেকে মাঠের চারপাশে ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীরাও সমাবেশস্থলে আসা শুরু করেছেন। তারা ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছেন। রাতে দলের পক্ষ থেকে তাদের খাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।সমাবেশের সুবিধার্থে শনিবার ভোরে ক্যাম্পগুলো অপসারণ করে পুরো মাঠ খালি করা হবে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে নগরীতে মোটরসাইকেল শোডাউন করে ছাত্রলীগ। কয়েকশ’ মোটরসাইকেল নিয়ে তারা পুরো নগরীতে শোডাউন করেন। একপর্যায়ে তারা বিএনপির সমাবেশস্থল সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের পার্শ্ববর্তী চৌহাট্টা মোড়ে অবস্থান নেয়। ঘণ্টাখানেক তারা সেখানে অবস্থান করে বিএনপি বিরোধী স্লোগান ও বক্তব্য দেয়। এসময় চৌহাট্টা এলাকায় আতঙ্ক দেখা দেয়। পথচারী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অপ্রীতিকর ঘটনারও আশঙ্কা করেন। অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে পুলিশও চৌহাট্টা এলাকায় অবস্থান নেয়। পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সেখান থেকে জিন্দাবাজারের দিকে চলে আসেন।
ছাত্রলীগের শোডাউনের সময় সমাবেশস্থলে অবস্থান করছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জীবন, সহসাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, ড. এনামুল হক, তাহসিনা রুশদির লুনা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য, সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ প্রায় একডজন নেতাসহ স্থানীয় বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। ওই সময় উভয়পক্ষ মুখোমুখি হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
সমাবেশস্থল পরিদর্শন শেষে ড. মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে যেখানে গণতন্ত্র নেই। তারা এক দলীয় শাসন কায়েম করেছে। অতীতে তারা বাকশাল কায়েম করেছিল। এখন আবারও একই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
তিনি আরও বলেন- ‘এখন দেশের মানুষ পরাধীন রয়েছে। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আমরা আন্দোলনে নেমেছি। এতে সাধারণ মানুষও স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। তারা আমাদের সহযোগিতা করছেন। আমরা বিশ্বাস করি এবার আওয়ামী দুঃশাসনের পরিসমাপ্তি হবে। ’ সিলেটের সমাবেশকে ‘লাকি সেভেন’ উল্লেখ করে ড. মঈন খান বলেন- ‘আমরা ইতোমধ্যে ৬টি সমাবেশ করেছি। শাহজালালের মাটিতে সপ্তম সমাবেশ হবে। ইনশাল্লাহ এই পবিত্র মাটিতে সমাবেশ সফল করে জনগণ সরকারকে বিদায় বার্তা জানাবে। ’
সমাবেশের দিন চলবে না কোন ধরণের যানবাহন,দুইদফা দাবিতে গত বুধবার বিএনপির সমাবেশের দিন তথা শনিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ‘সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি’। দুই দফা দাবিতে ঔইদিন সিলেট জেলায় কোন ধরণের বাস চলাচল করবে না বলে জানিয়েছিলেন পরিবহন মালিকরা। তাদের দাবির মধ্যে ছিল নতুন করে সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন না দেওয়া এবং অটোরিকশায় ৩ জনের বেশি যাত্রীবহন না করা ও চালকের আসনের পাশে গ্রিল সংযোজন। তবে বাস ব্যতীত অন্যসব পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা ওইদিন ছিলেন ধর্মঘটের বিপক্ষে।
কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে ‘সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’ চারদফা দাবিতে শনিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ধর্মঘটের ডাক দেন। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- সিলেটের সকল পাথর কোয়ারি খুলে দেয়া, লামাকাজি ও শেওলা সেতুতে টোল আদায় বন্ধ, নতুন সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন প্রদান ও মহাসড়কে টমটম, নছিমন চলাচল বন্ধ। দুদফায় শ্রমিক ও মালিকদের ধর্মঘটের ফলে বিএনপির গণসমাবেশের দিন সবধরণের যান চলাচল অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এছাড়া বিএনপির গণসমাবেশ সফলে প্রস্তুতি সভা, সমাবেশ ও প্রচারণাকালে বিভাগের হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার পুলিশের সাথে দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গ্রেফতারও হয়েছেন কয়েকজন। সিলেটের ওসমানীনগরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছেন বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম. ইলিয়াস আলীর স্ত্রী, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদির লুনার গাড়ির সামনের গ্লাস। এছাড়া ওসমানীনগের ছাত্রদল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে সমাবেশের আগে আরও ধরপাকড়েরও আশঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা।
তবে এই পরিস্থিতিতেও খুব বেশি শঙ্কিত নন সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির শীর্ষনেতারা। পরিবহন ধর্মঘট, হামলা, মামলা ও ধরপাকড়কে তারা সংশ্লিষ্টদের ‘রুটিন ওয়ার্ক’ হিসেবেই দেখছেন। সকল বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সমাবেশের দিন সিলেট নগরী জনসমূদ্রে পরিণত হবে বলে আশাবাদী তারা।
এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ূম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে মহাসমাবেশ ডাকার পর জনস্রোত আটকাতে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে দেশের যেখানেই সমাবেশ ডাকা হয়েছে সেখানে একইভাবে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু কোনকিছুতেই মানুষকে আটকে রাখা যায়নি। সিলেটেও পরিবহন ধর্মঘট মহাসমাবেশে কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ বিকল্প পন্থায় যে যেভাবে পারে কষ্ট করে হলেও সমাবেশে আসবে।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসা শুরু করেছেন। তারা সমাবেশস্থলে তৈরি করা ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। সেখানেই তারা রাত্রিযাপন করবেন। পরিবহন ধর্মঘটে বিএনপির কোন ক্ষতি না হলেও সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ছাত্রলীগের শোডাউন ও বিভিন্ন স্থানে হামলা, মামলায় নেতাকর্মীরা আতঙ্কিত কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল কাইয়ূম চৌধুরী বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন আর কিছুতেই ভয় পায় না। ১৪ বছর ধরে তাদেরকে নানাভাবে ভয়ভীতি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। তাই নতুন করে তাদের আতিঙ্কত বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে গণসমাবেশ সফল করবে নেতাকর্মীরা।
নবচেতনা / এমএআর