বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী ‘গুম’ হওয়ার বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে বিএনপির মহাসচিবের কাছে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
বৃহস্পৃতিবার (২২ এপ্রিল) বিকেলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দেওয়া এ সংক্রান্ত একটি চিঠি মির্জা আব্বাসের কাছে বিশেষ বাহকের মাধ্যমে পৌঁছানো হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশক্রমে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মির্জা আব্বাসের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ ধরনের কোনো চিঠি তার কাছে আসেনি। আর যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
মির্জা আব্বাসকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘দেশে সরকারের বিরুদ্ধে আজ সার্বজনীনভাবে এক ধরনের জনমত তৈরি হয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে আপনার বক্তব্য বিরোধী জনমতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়; এই সুযোগে অবৈধ সরকার তাদের বক্তব্যকে ভিন্ন খাতে প্রচার করে অপরাধের কৌশল আড়াল করতে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে।’
চিঠিতে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মির্জা আব্বাসকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সকলের কাছে স্বীকৃত যে, ২০০৯ সাল থেকে এ দেশে অবৈধ একটি সরকার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য রাজত্ব কায়েম করেছে। তার অংশ হিসেবেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী দলগুলোর অনেক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে গুম ও হত্যা করছে। সরকারের এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃত।’
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এসব হত্যা ও গুম বন্ধেরও দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু নতজানু ও ক্রীড়নক সরকার বিরোধীদের দমন করার জন্য গুম ও হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। অথচ, এরকম পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১৭ এপ্রিল এক সভায় ইলিয়াস আলী গুমের বিষয়ে আপনি বক্তব্য রেখেছেন।’
ব্যাখ্যা চওয়ার কারণ উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, ‘ আপনার ওই বক্তব্যের ফলে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ছাড়াও ইলিয়াসের পরিবার এবং ভুক্তভোগীরা বেদনাহত হয়েছেন। এই ভুল বোঝাবুঝি দূর করা এবং দলীয় ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এজন্য দলের একজন নীতিনির্ধারক হিসেবে আপনার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি শুভান্যুধায়ীরাও প্রত্যাশা করেন।’
উল্লেখ্য, সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় ইলিয়াস আলীর ‘গুমের’ জন্য বিএনপিরই কতিপয় নেতাকে দায়ী করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ওই নেতাদের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘দলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই ব্যক্তিদের অনেকেই চেনেন।‘ আওয়ামী লীগ সরকার ইলিয়াস আলীকে গুম করেনি, এমন মন্তব্য করেন তিনি।
মির্জা আব্বাসের এ বক্তব্যে তোলপাড় শুরু হলে বিষয়টি সামাল দেওয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তাকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সমাধানের জন্য বলা হয়। এজন্য দলের পক্ষ থেকে একটি লিখিত বক্তব্য তৈরি করে দেওয়া হয় তখন। ওই বক্তব্যে ‘ভুল বোঝাবুঝি ও দুঃখ প্রকাশের’ কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু মির্জা আব্বাস সেটি বিবেচনায় না নিয়ে ১৮ এপ্রিল নিজের মতো সংবাদ সম্মেলন করেন। রাজধানীর শাহজাহানপুরের নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, তার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এজন্য তিনি গণমাধ্যমকে দায়ী করেন। এতে আরও ক্ষুব্ধ হয় দলের হাইকমান্ড।
বিষয়টি নিয়ে স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার লিখিত চিঠি পাঠিয়ে মির্জা আব্বাসের কাছে তার বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা চান বিএনপি মহাসচিব।
এদিকে মির্জা আব্বাসের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়াকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। দলের একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেছেন, মির্জা আব্বাস দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার মতো নেতাকে যদি সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে এভাবে চিঠি ইস্যু করা হয়, তা অবশ্যই দুঃখজনক। আবার বিএনপির নেতাকর্মীদের একটি অংশও বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি।
তারা মনে করেন, মির্জা আব্বাস দলের ত্যাগী নেতা, এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। বিএনপির রাজনীতিতে ইলিয়াস আলী তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার ব্যাপারে তিনি সব সময় দুর্বল। তার ঘটনায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে ওই বক্তব্য দিয়েছেন। এর জন্য বিএনপি অতি মাত্রায় রিঅ্যাকশনদেখাচ্ছে। তাও দলের কয়েকজন নেতার পরামর্শে।
অপর পক্ষ দাবি করছে, চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখতে দলের সিদ্ধান্ত মানতে হবে। এর আগেও গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর দলের দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে চিঠি দিয়েছিল বিএনপি। কেউ দলের ঊর্ধ্বে নয়, এসবের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট করা হয়েছে।