এ যুগের সাংবাদিকতার কথা বললেই তা যে অন্য যুগ বা অন্য সময় থেকে ভিন্ন সেটি সহজে অনুমেয়। এ ভিন্নতাকে বহুমাত্রিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন- এ যুগের সাংবাদিকতা বহুমাধ্যমকেন্দ্রিক…
সাংবাদিকতা একটি সতত পরিবর্তনশীল পেশা। অন্য যে কোনো পেশা থেকে সাংবাদিকতা সময় ও সমাজ বাস্তবতা দ্বারা নির্ধারিত হয় বেশি। সমাজকে যদি একটি সিস্টেম হিসেবে ধরা হয় তাহলে এর অন্তর্গত বহুবিধ সাব-সিস্টেম সদা পরস্পর মিথস্ক্রিয়ারত থাকে। এ সাব-সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তি, সাংস্কৃতিক অবস্থা, পরিবার ব্যবস্থা, স্থানীয় ও বৈশ্বিক অবস্থার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, পরিবেশ, জলবায়ু ইত্যাদি। এসবের মধ্যে একটি বিশেষ সমাজ বাস্তবতায় সাংবাদিকতার চর্চা হয় প্রতিটি দেশে, প্রতিটি সমাজে।
তাই এ যুগের সাংবাদিকতার কথা বললেই তা যে অন্য যুগ বা অন্য সময় থেকে ভিন্ন সেটি সহজে অনুমেয়। এ ভিন্নতাকে বহুমাত্রিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন- এ যুগের সাংবাদিকতা বহুমাধ্যমকেন্দ্রিক। সাংবাদিকতার এ বহুমাধ্যমকেন্দ্রিকতা হঠাৎ করেই উদ্ভাবিত হয়েছে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। মূলত কালের পরিক্রমায় উদ্ভাবিত সাংবাদিকতার বিভিন্ন কাঠামোকে ধারণ করেই আজকের সাংবাদিকতা বহুমাধ্যম বৈচিত্র্য অর্জন করেছে।
সাংবাদিকতার আদিরূপ এক মাধ্যমকেন্দ্রিক ছিল যাকে আমরা সাংবাদিকতার মুদ্রণমাধ্যম যুগ বলতে পারি। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, পেমফ্লেট ইত্যাদিকে আমরা এ গোত্রভুক্ত করতে পারি। মুদ্রণ মাধ্যম সাংবাদিকতাকে আমরা প্রথমত দুই ভাগে দেখতে পারি। যেমন- হস্তলিখিত মুদ্রণমাধ্যম ও প্রযুক্তিবাহিত মুদ্রণমাধ্যম। প্রাচীন আমলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের রাজ-রাজারা বিশেষ লেখক-নবিসদের মাধ্যমে হস্তলিখিত সংবাদপত্র প্রস্তুত করে তা রাজন্যবর্গকে বিতরণ করতেন। সাধারণ মানুষের জন্য সেগুলো রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টাঙিয়ে রাখা হতো। পনের শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ ব্যবস্থায়ই কার্যকর ছিল। পরবর্তীতে জার্মানির গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করলে সংবাদপত্র তা দ্রুত গ্রহণ করে এবং মুদ্রিত সংবাদপত্রের যুগ শুরু হয়। মুদ্রণমাধ্যমের এ একক সাংবাদিকতার যুগকে আমরা মোটা দাগে তিন পর্বে বিভক্ত করে দেখতে পারি। শিল্পবিপ্লব পূর্বকাল, শিল্প বিপ্লবোত্তর কাল ও বিশ্বায়ন কাল।
শিল্পবিপ্লব পূর্বকালে মুদ্রণ সাংবাদিকতা ছিল অনেকটা পারিবারিক পরিসরে। অনেকটা কটেজ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এর তুলনা করা যায়। পরিবারের সদস্যরাই বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতেন। যেমন- কেউ সম্পাদক, কেউ রিপোর্টার, কেউ আবার নিউজ ম্যানেজার। এ পর্বে সাংবাদিকতার ‘অডিয়েন্স’ তথা সংবাদের ‘পাঠক’ আজকের বিবেচনায় ‘বাজার’ ছিল সীমিত। অল্প সংখ্যায় প্রকাশিত হয়ে স্থানীয় মানুষের তথ্য চাহিদা মেটানোই ছিল এ সময়ের সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপে কুটির শিল্পের সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে বৃহৎ শিল্পে রূপ লাভ করে। শিক্ষা ও পুঁজি বিকাশের ফলে বড় পাঠকসমাজ তৈরি হয়। শিল্প বিপ্লব পর্যায়ের সাংবাদিকতায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত সংবাদপত্র উৎপাদন ও পাশাপাশি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মিথস্ক্রিয়ায় সাংবাদিকতার বাজার সম্প্রসারিত হয়। মূলত বিংশ শতকে এসে সাংবাদিকতা বহুমাধ্যম বাহিত পেশায় রূপ লাভ করতে থাকে। রেডিও, টেলিভিশনের আবিষ্কার এবং সাংবাদিকতায় এ মাধ্যমগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতায় বহুমাধ্যম বা মাধ্যম বৈচিত্র্য যুগের সূচনা ঘটে।
এ পর্যায়ে এসে বিশ্বায়নের ফলে সাংবাদিকতার চিরায়িত স্থানীয় চরিত্রের পরিবর্তন শুরু হয়। ধীরে ধীরে সাংবাদিকতা একটি বৈশ্বিক রূপ লাভ করতে থাকে। বিশ্বায়নের লম্বা সময়ে সাংবাদিকতা সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনের ক্ষেত্রে বিশেষায়িতভাবেই চর্চিত হতে থাকে। একবিংশ শতকের গোড়া থেকে মূলত সাংবাদিকতা প্রাযুক্তিক প্রভাবে মাধ্যম বহুমাত্রিকতার পাশাপাশি চর্চায় বহুমাত্রিক রূপ পেতে থাকে। এ যুগের সাংবাদিকতায় যেসব চরিত্র পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার ও বহু-আধেয় ভিত্তিক চর্চাই অন্যতম। এক সময় সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ব্যবহার বলতে ছাপাখানা বা প্রিন্টিং প্রেসকে বুঝানো হতো। রেডিও, টেলিভিশনের ক্ষেত্রে স্টুডিও থেকে ট্রান্সমিশন কৌশলকে বুঝাত। কিন্তু এ যুগের সাংবাদিকতা প্রতিটি স্তরেই প্রযুক্তিনির্ভর।
মোটা দাগে সাংবাদিকতা প্রক্রিয়ার পাঁচটি পর্যায় রয়েছে। যেমন- ১। সংবাদ প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা, ২। সংবাদপত্র বা সম্প্রচারের জন্য প্রতিবেদন প্রস্তুত করা, ৩। সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনা, ৪। সংবাদ মুদ্রণ অথবা যোগাযোগ উপগ্রহ কিংবা অন্তর্জাল উপযোগীকরণ, ৫। নিউজ ডেলিভারির লক্ষ্যে বিতরণ/প্রচার/সম্প্রচার অথবা অন্তর্জালের সঞ্চালনা।
সব মাধ্যমের সাংবাদিকতা চর্চায়ই উল্লিখিত প্রতিটি পর্যায়ে প্রযুক্তি আজ অপরিহার্য নিয়ামক। সমাজে যারা প্রবীণ তারা যৌবনে দেখেছেন সংবাদকর্মীরা প্রতিবেদনের ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটেরিয়াল সংগ্রহের জন্য এ অফিসে, সে অফিসে যাতায়াতে বহু সময় ব্যয় করছেন। উপরন্তু প্রাপ্ত তথ্য তাদের হাতে লিখে নিতে হতো। সেজন্য পৃথিবীব্যাপী সাংবাদিকরা সাঁটলিপি ব্যবহার করতেন। কিন্তু এ যুগের সাংবাদিকতায় তথ্য সংগ্রহের সেকেলে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক প্রতিবেদনের ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটেরিয়াল এখন ঘরে বসে ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। তাড়াহুড়া করে হাতে লিখে নোট নেওয়ার পরিবর্তে তথ্য রেকর্ড করার বিভিন্ন ডিভাইস এখন সহজলভ্য। এসবের ব্যবহার জানা ছাড়া এখন সাংবাদিকতার চিন্তাই করা যায় না। এমনকি স্মার্টফোন ভিত্তিক কনভারজেন্স টেকনোলজির ফলে এখন উন্নত, অনুন্নত সব দেশেই Mojo বা ‘মোবাইল জার্নালিজম’ সাংবাদিকতার প্রযুক্তিনির্ভর সাংবাদিকতার স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। হার্ড কপির ওপর সম্পাদনার যুগ আর এখন নেই। ইলেক্ট্রনিক সাবিং ও এডিটিং অনেক আগেই উন্নত বিশ্বে শুরু হয়েছে। ২০০০ এর পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশেও সংবাদ সম্পাদনায় আগের সেই অশ্ব-খুরাকৃতির টেবিলের পরিবর্তন ঘটে গেছে। নিজ নিজ ডেস্কে বসে সহসম্পাদকরা এখন ল্যানযুক্ত কম্পিউটার টার্মিনালে থেকে ইলেক্ট্রনিক সাবিং ও এডিটিংয়ের কাজ করছেন।
প্রিন্টিং প্রযুক্তির পরিবর্তন ও আধুনিকায়নে ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল সুবিধার আওতায় সংবাদপত্র মুদ্রণে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণেই বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা আজকাল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুদ্রিত হয়ে স্থানীয় পাঠকের কাছে দ্রুত পৌঁছে যায়। আমরা জানি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, টাইম সাময়িকীসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রিন্ট মাধ্যম স্থানীয়ভাবে মুদ্রিত হয়, যা অতীতে কল্পনাও করা যেত না। বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা থেকে প্রকাশিত অনেক সংবাদপত্রই ঢাকা থেকে মুদ্রিত হয়ে স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করে। এসবই সম্ভব হয়েছে তথ্য প্রযুক্তি তথা অযুত-নিযুত ডাটা বাহনে ও প্রকৃত সময় সঞ্চালনা বা রিয়েল টাইম ট্রান্সমিশনে সক্ষম অন্তর্জাল প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে।
নিউজ ডেলিভারিও আমূলভাবে বদলে গেছে। রেডিও, টেলিভিশন নির্দিষ্ট সময় অন্তর সংবাদ পরিবেশনের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার রিয়েল টাইম কাভারেজ দিচ্ছে। ঘটনার সংবাদভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছে। প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অনলাইন সাংবাদিকতা স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাংলাদেশে অসংখ্য নিউজ পোর্টাল রয়েছে। দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিকতা এখন আর ২৪ ঘণ্টার টাইম ফ্রেমে বন্দী নেই। সংবাদপত্রসহ সব গণমাধ্যমেরই এখন নিউজ ওয়েবসাইট রয়েছে। যেখানে প্রতিটি ঘটনার তাৎক্ষণিক আপডেট পাওয়া যাচ্ছে। এভাবেই এ যুগের সাংবাদিকতা পূর্বকাল থেকে নবতর রূপ পরিগ্রহ করে চলেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ সময়ে সাংবাদিকতা মূলত বহুমাধ্যম বাহিত সমকেন্দ্রমুখী (convergence) প্রযুক্তিনির্ভর একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা।