মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির নামে সিন্ডিকেট গড়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ (লোটাস কামাল) তিনজন সাবেক সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সিন্ডিকেট সদস্যরা দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ পেয়েছে সংস্থাটি। দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম অভিযোগের অনুসন্ধান করবে। দুদক ইতোমধ্যে অভিযোগের বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে। এদিকে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যে হাউজিং খাতে বিপুল বিনিয়োগ ও শতাধিক বাড়ি কেনার তথ্য বেশ কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে আলোচিত হলেও দুদক নীরব ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্থাটি এখন সাইফুজ্জামানের বিদেশে বাড়ি কেনার বিষয়টিও অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে।
জানা গেছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলেন- সাবেক সংসদ-সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ ও আ হ ম মুস্তফা কামাল। চক্রে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে, অন্যটি মেয়ে নাফিসা কামালের নামে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এরা সবাই আত্মগোপনে আছেন। এর মধ্যে আ হ ম মুস্তফা কামাল পালিয়ে সিঙ্গাপুরে গেছেন বলে জানা গেছে।
দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী ও তিন সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে কমিশনের অনুমোদনক্রমে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছিল।
দুদকের তৈরি করা সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ফেনী ২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড নামে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন। এরপর সাড়ে ৩ বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠায় স্নিগ্ধা। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সিন্ডিকেটে যোগ দেওয়ার পর দেড় বছরে প্রায় ৮ হাজার কর্মী গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির নামে। ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল নামে রিক্রুটিং এজেন্সি করেন। মালয়েশিয়ায় এককভাবে শ্রমিক পাঠানোর শীর্ষে রয়েছে ফাইভ এম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মতো কর্মী পাঠালেও মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে ৮ হাজার ৫৯২ কর্মী।
জানা গেছে, সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য বেনজীর আহমেদ। তার প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর দিক থেকে পঞ্চম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার চালুর আগে তাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। বিদেশে পাঠিয়েছিল মাত্র ২৩৮ কর্মী। তবে মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটে ঢুকে তারা শীর্ষ তালিকায় চলে যায়। তার প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ কর্মী। সিন্ডিকেট তৈরির সময় বেনজীর ছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গেছেন মোট ৯ হাজার ৮৬১ জন। এ সিন্ডিকেট গঠনের সময় তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, সাবেক তিন সংসদ-সদস্য ও অর্থমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এ খাতের নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশে এমন সিন্ডিকেট নেই। সিন্ডিকেটের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। সিন্ডিকেটে থাকা এজেন্সিগুলো বসে বসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে অন্তত দেড় লাখ টাকা ‘কমিশন’ পাচ্ছে। অন্যান্য এজেন্সির মধ্যে অন্যতম হলোÑ ঐশী ইন্টারন্যাশনাল, নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড, পিআর ওভারসিজ, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ, বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড এবং অনন্য অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সি।
দুদকের সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে চার লাখের মতো কর্মী পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সিন্ডিকেটের কমিশন নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসাবে পরিচিত রুহুল আমিন ওরফে স্বপনকে দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি। দুদকের সারসংক্ষেপেও তার নাম আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি।