তীব্র শীতে যখন আমরা ঘরে কম্বলের নিচে শরীর গরম করছি তখনি কনকনে শীতে একজন খেজুর গাছি রস সংগ্রহে ব্যস্ত। শীতের মওসুমে তার ফুসরত নেই। কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় গাছির রস সংগ্রহ।
শীতের শুরুতে গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন গাছ প্রস্তুত করতে রস সংগ্রহের জন্য। গাছিরা খেজুর গাছ তোলা-চাছার জন্য দা, চোং বা নলি, কাঠি, দড়ি, ভাঁড় ইত্যাদি জোগাড়ে ব্যস্ত গাছি। এই উপকরণের সাথে তার চির পরিচয়। দা, চোং, ভাঁড় প্রতিটা উপরকনই শীতকালে গাছির জীবনেরই একটা অংশ হয়ে ওঠে।
শীতের মওসুম শুরু হতেই আমনধানের পাকা শুরুর সময় থেকে শুরু হয় গাছ তোলার কাজ।
গাছ তোলার পর গাছের খেজুর পাতা সংরক্ষণ করেন গাছি। এই খেজুর পাতাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন গাছিরা। খেজুর পাতা দিয়ে আরও নানারকম শিল্প তৈরি করেন শীতল পাটি, ফুলদানি, হাতপাখা, ছিকা, ফুল প্রভৃতি।
এর পর থেকে নিয়ম করে প্রতি ৪-৫ দিন পর পর ঢিলা/ভাড় পরিষ্কার করে ভাড়ে আগুনের আঁচ লাগিয়ে গাছিরা চলে যান মাঠে গাছ কাটার জন্য।
সাকাল ১০-১১টা থেকে গাছ কাটার কাজ চলতে থাকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। শরীরের কোমড়ের সাথে দড়া (এক ধরনের মোটা দড়ি বিশেষ) গাছে বাঁধিয়ে গাছ ধরে গাছে থরে থরে একে একে পা দিয়ে গাছি উঠে যান গাছের মাথায়। যেখানে নৈপুন্যের সাথে খেজুর গাছের চোখ কেটে রস সংগ্রহ করেন গাছি।
খেজুর গাছের চোখ কাটার পর নলি দিয়ে যখন রস পড়তে থাকে হাসিফুটে তখন গাছির মুখে। গাছি তখন ভাঁড়/ঢিলা বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে যান গাছের সাথে।
নলি দিয়ে গাছির হাসিভরা খেজুর রস নলি দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ন্যায় রাতভর পড়তে পড়তে ভাড় পূর্ণ হয়ে যায় খেজুরের রসে।
গাছির ভোর থেকে শুরু হয় ব্যস্ততা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে হবে। কনকনে শীতে যুবধুব হয়ে ফজরের নামাজ পড়েই গাছি চলে যান গাছ থেকে রস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। গাছ থেকে ঢিলার পর ঢিলা নামাতে থাকেন। একের একের পর এক গাছ বেয়ে হাসিমাখা মুখে নামিয়ে আনেন রসভর্তি ঢিলা।
গাছপাড়া যগ্যের শেষে এবার রস বাড়ি নেবার পালা। রস বাড়ি নিয়ে জ্বালিয়ে তার থেকে তৈরি করা হবে খেজুর গুড়।
বেরেল বা হাড়িতে ঢালেন রসভর্তি ঢিলার পর ঢিলা। খড়কুটা দিয়ে জ্বালিয়ে শৈল্পিকভাবে রস থেকে তৈরি করেন খেজুরের গুড়।
খেজুরের গুড় যেন হাসতে থাকে কৃষকের চেহারায়। সযন্তে ঢিলায় সংরক্ষণ করে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যান গাছি। গুড় বিক্রি করে পরিবারের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করে থাকেন গাছিরা।
বছরের পর বছর ধরে গাছিদের পরম নৈপুণ্য শ্রম আর স্নিগ্ধছোঁয়া ভালোবাসায় তৈরি হয় শৈল্পিক গুড় আর গুড় পৌঁছে যায় সারাদেশে। গুড়ের স্বাদে যখন আমাদের মন ভরে যায় তখন গুড়ের কারিগরের শ্রম হয় সার্থক।
কথা হয় কেশবপুরের ষাটোর্ধ্ব গাছি মশিয়ারের সাথে গল্পে গল্পে মশিয়ার গাছিদের সুখ দুঃখ নিয়ে কথা বলছিলেন। মশিয়ার বলেন আগে আমাদের গ্রামে আমরা গাছি ছিলাম প্রায় ৪০-৫০ জন। এখন গাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে সাথে সাথে গাছির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এখন গ্রামে গাছি আছে হাতেগোনা কয়েকজন। রস-গুড় বিক্রিকরে সংসার চালান কঠিন হওয়ায় এখন আর কেউ গাছি হতে চায় না। তাছাড়াও এখন গাছে তেমন রস হয় না, গাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এখন আমরা যারা গাছি আছি এই কাজের একটা মায়ায় পড়ে গেছি তাই এই কাজ ছেড়ে থাকতে পারি না। মশিয়ার গাছি দুঃখের সাথে বলছিলেন অদূর ভবিষ্যতে হয়তো হারিয়ে যাবে এই শিল্প!