হরিপুর চরের ৭৫ বছর বয়সের আমেনা বেওয়া জানান, ‘হামরা জারত মরি গেইনো বাহে। কেডা হামাক জারের কাপড় দিবে। ভোট আইলে সবাই এটা দিবে, ওটা দিবে কইয়া ভোট নিয়ে যায়, এখন হামরা জারত মরি কারো দেখা পাও না। আজ কইদিন থাকি আগুন জ্বলেয়া ছাওয়াল পোয়াল বাড়ির গেরস্তকে নিয়ে কষ্ট করি রাত দিন পার করছি। হামার নেম্বর, চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপি এখন কেউ আইসে না। ভোট নেবার সময় যে নেতারা আসছিল, তাকো আর দেখ না। হামারঘরে খুব কষ্ট হইছে বাবা। তোমরা সাংবাদিকের বেটারা হামার কষ্টের কথা বেশি করি নেখি দেন বাবা।
গত এক সপ্তাহ ধরে ঘন কুয়াশা, কন-কনে ঠান্ডা ও শৈত প্রবাহের কারণে অসহায় ও ছিন্নমুল পরিবারগুলো কাবু হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের ভাসমান পরিবারগুলো ঠান্ডায় দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। স্থবির হয়ে পড়েছে সকল কার্যক্রম। ঘন কুয়াশা এবং ঠান্ডায় অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ীরা যথা নিয়মে কর্মস্থলে উপস্থিত হতে পারছে না। যানবাহন চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পরেছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে সড়ক দূর্ঘটনা। খড় কুঁটো জ্বালিয়ে ঠান্ডা নিবারণ করতে গেয়ে এক সপ্তাহে চারটি বসত বাড়িতে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে। ঠান্ডার কারণে নানাবিধ রোগব্যধির প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপ-কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ওষধের দোকানগুলো রোগীর ভিড় লক্ষা করা গেছে।
উপজেলা সমাজসেবা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ১৫টি ইউনিয়নে কমপক্ষে ৫০ হাজার ছিন্নমুল পরিবার রয়েছে। নিম্ন আয়ের এই পরিবারগুলো শীতবস্ত্রের অভাবে অসহনীয় ঠান্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরকারি ও বেসরকারি ভাবে শীতবস্ত্র বিতরণের পরিমান একেবারেই অপ্রতুল। এ পর্যন্ত সরকারি ভাবে পৌরসভাসহ প্রতিটি ইউনিয়নে ৪৯০ পিস করে মোট ৭ হাজার ৮৪০ পিস কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। চরের ছিন্নমুল পরিবারগুলো খড় কুঁটো জ্বালিয়ে ঠান্ডা নিবারণ করছে। বিশেষ করে বৃদ্ধা-বৃদ্ধা, শিশু ও প্রসূতি মা’রা নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
বেলকা নবাবগঞ্জ চরের আকবর আলী জানান, গত কয় দিনের ঠান্ডায় চরের মানুষের অনেক কষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে বয়বৃদ্ধা, শিশু ও গর্ভবতি মা’দের নিদারুন কষ্ট হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন প্রকার শীতবস্ত্র পায় নাই। ঠান্ডার কারণে কাজকর্ম করা যাচ্ছে না। অনেকে বাড়ির মধ্যে খড় কুটো জ্বালিয়ে বসবাস করছে।
তারাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানান, সরকারিভাবে যে পরিমান কম্বল বিতরণ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। তাঁর ইউনিয়নে ছিন্নমুল মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ৮ হাজার। অথচ সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কম্বল দিয়েছে মাত্র ৪৯০ পিস। যা বিতরণ করতে গিয়ে শীতার্ত মানুষের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে চেয়ারম্যান মেম্বরদের। শীতে যে ভাবে জেঁকে বসেছে, তাতে করে শীতবস্ত্রের চাহিদা মেটাতে না পারলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। তিনি প্রশাসনের নিকট অতিদ্রুত চাহিদা মোতাবেক শীতবস্ত্র বিতরণের দাবি জানিয়েছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিফ মন্ডল জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে প্রচন্ড ঠান্ডা দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে এ পর্যন্ত প্রায় ৮ হাজার শীতবস্ত্র পাওয়া গেছে, তা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। আবারও চাহিদা পাঠানো হয়েছে, বরাদ্দ পেলে বিতরণ করা হবে। তবে শীতার্ত মানুষের চেয়ে শীতবস্ত্রের পরিমান অনেক কম।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার এনামুল হক জানান, প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে হাঁপানি, এ্যাজমা, নিমোনিয়া, পেটের পীড়া, স্বদি কাশিসহ নানাবিধ রোগীর সংখ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দুই মাসের তুলনায় রোগীর সংখ্যা দ্বিগুন হারে বেড়ে গেছে। মুলত ঠান্ডর কারণে এসব রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু, ও প্রসূতি মা’রা বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।