আমিনুল হক, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : “একটি দমের নাই ভরসা কিসের বাহাদুরী, তোমার মনে কেন জাগে না ছাড়তে হবে এ ঘর বাড়ি” এভাবেই গুন গুনিয়ে গান শুনাচ্ছিলেন দেশ বরেণ্য লোকোশিল্পী, চারবারের বঙ্গবন্ধু পদকে ভূষিত বেতার ও টিভির শিল্পী সৈয়দ নুরুল আওয়াল তারামিঞা। সম্প্রতি হার্টে ব্লক ধরা পরায় প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে হার্টে ৩টি রিং পরিয়ে এখন বাসায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন এই শিল্পী। সরকারী চাকুরী জীবনের পেনশনের টাকা দিয়ে বাড়ি করবেন বড় আশা ছিলো। বাড়ির কাজ শুরুও করেছিলেন কিন্ত গুরুতর অসুস্থতায় সব ভেস্তে গেলো। জীবনের শেষ সম্বল দিয়ে স্ত্রী পুত্র কন্যাদের জন্য বাড়িটাও করতে পারলেন না।
আমাদের সমাজ গুণীদের কদর করতে জানেনা ফলে গুণী শিল্পীরাও সময়ের সঠিক মূল্যায়ন পায় না। যেমনটা হয়েছে এ শিল্পীর ব্যাপারে। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ জেলা শিল্পকলায় অনেক শিল্পীদেরকে বিভিন্ন ক্যাটাগড়িতে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। কিন্ত তাতে বাদ পরে তারামিঞা। তিনি বলেন, “আমার জুনিয়র অনেক কেই সম্মাননা দেয়া হয়েছে অতচ আমাকে একটা আমন্ত্রন পত্রও দেয়া হয়নি। একটা সময় ছিলো সরকারি, বেসরকারি এমন কোনো প্রোগ্রাম নেই যেখানে আমি গান গাইনি। অন্য শিল্পীরা যেখানে আগেই টাকার কন্ট্রাক করে সেখানে আমি নিজ খরচেও গান গেয়েছি আমার দল নিয়ে। টাকা পয়সার থোরাই কেয়ার করেছি। গান গেয়েছি দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি নিজের দায়বদ্ধ্বতা থেকে।”
সারা বাংলাদেশেই তার পরিচিতি। বেশী পরিচিতি লাভ করেছেন কৃষি, পরিবেশ, মৎস্য, পশু পালন, জনস্বাস্থ্য, বার্ড ফ্লু, এইডস, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, আর্সেনিক, স্যানিটেশন, মাদকবিরোধী, গণশিক্ষা ইত্যাদি বিষয় ভিত্তিক গান গাওয়া ও লেখায়। এসব বিষয়ে লিখেছেন তিন হাজারের অধিক গান, জারীগান, ছড়া, কবিতা। এক কথায় বলা যায় তারা মিঞা কৃষি গানের সম্রাট, কৃষি গানের যাদুকর। একটা সময় ছিলো যখন কিশোরগঞ্জ তথা বৃহত্তর মময়মনসিংহের যেকোনো সরকারী অনুষ্ঠান মানেই ‘তারাভাই’ এর গান। তারামিয়ার উপস্থিতি টের পেলে উপস্থিত দর্শক শ্রোতা অন্য শিল্পির গান শুনতে চাইতো না। যিনি কৃষি ভিত্তিক গান গেয়ে গণ মানুষকে জাগিয়ে তুলছেন দীর্ঘ ৪০ বছর পূর্ব থেকে। গণমানুষকে কৃষি ক্ষেত্রে উদ্ধুুদ্ধ করার অসামান্য অবদান রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তারামিঞাকে চারবার কৃষি উন্নয়নে “রাষ্ট্রপতি পদক” ও “বঙ্গবন্ধু পদকে” ভূষিত করেছেন।
পরিবেশ রক্ষার জন্য গেয়েছেন “দেশের বাতাস উল্টে গেলরে আষাঢ় মাসে খরা ভাই-সেচের চিন্তা কর আগে আয় আয়রে চাষী ভাই”। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গেয়েছেন “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই, মানুষের বাঁচার জন্য খাদ্যের যোগান চাই”। রাসায়নিক সার ব্যবহার, বেশি ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়, তাই তিনি গেয়েছেন- “সারের রাজা জৈব সার- গোবর কম্পোষ্ট সবুজ সার, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করে করলে ব্যবহার”, শরীর সুস্থ্য রাখার জন্য পুষ্টি প্রয়োজন তিনি গেয়েছেন বিখ্যাত সেই গান- “স্বাস্থ্য পুষ্টি অর্থ চান, ফলের চারা বেশী লাগান- ফলে ফলে ঝগড়া করে মূল্য বেশী কার”, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের বাঁশী হিসাবে তারামিঞা গায়- “সামনে মোদের আসছে দুর্দিন বাঁচার আশা দায়- ঔষধী গাছ লাগাও আঙ্গীনায়”, বার্ড ফ্লু থেকে বাঁচার জন্য সচেতণতা প্রয়োজন।
তাই তিনি গেয়েছেন- “হাঁস মুরগী কাইট্যা কুইট্যা, হাতে লাগাও সাবান- বার্ড ফ্লু থেকে থাকিও সাবধান”, মৎস্য চাষ বৃদ্ধির জন্য গেয়েছেন- “দেখা দিছে মাছের আকাল-বাজারেতে মিলে না তাড়াতাড়ি ছাড় ভাই রুই কাতলার পোনা” কৃষকের অতি কষ্টের ফসল ইঁদুরে প্রায় ২৫ ভাগ নষ্ট করে। তাই কৃষকদেরকে ইঁদুর মারতে উদ্ভুদ্ধ করনের জন্য তিনি গেয়েছেন- “ছুটলে ধরা দিবেনা ইঁদুর পাইলে খাতির কইর না”। সু ফসল পেতে হলে ভালো বীজ লাগবে, সেজন্য তিনি ছন্দ মিলিয়ে লিখেছেন, “ সু -বংশে সু-সন্তান সুধীজনে কয়, সু-বীজে সুফসল জানিবে নিশ্চয়” এই ছন্দটি এখন কৃষি বিভাগের অন্যতম স্লোগান। যার আবিস্কারকও এই তারামিয়া।
অধিক ফসলের জন্য হাইব্রিড ধানের আবাদ আমাদের জরুরী, তাই তিনি গেয়ে বেড়ান “আদরের বুবুজান, শুন তারামিঞার গান, ধানের মাঝে হাইব্রিডের ফলন খুব ভালা”। তিনি আরও গেয়েছেন- “কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষির উন্নতির মূলে, সু-ফসলের আশা বৃথা- সু-বীজ না হলে”, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ রোপনের বিকল্প নাই “বাঁচার আশা আছে যার, গাছের চারা লাগাও এবার। দুলনা থেকে কবর যেতে গাছের ভাই দরকার”। শাক সব্জী বেশী খাবার জন্য তিনি দেশবাসীকে জানান “আঙ্গীনাতে করাগা বাগান, সারা বছর খাও সব্জী নিয়া পুলা পান। এছাড়াও তিনি কৃষি বিষয়ক কয়েকটি নাটক লিখে দেশের বিভিন্ন কৃষক সমাবেশে মঞ্চস্থ করেছেন। তন্মধ্যে “এসো দেশ গড়ি” “ক্ষেতে খামারে” “বাড়ই খালির পাড়ে” এবং গন শিক্ষা মূলক নাটক “আলোর পথে” বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ করে বেশ সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছে। তার কাছে বসলেই বুঝা যায় তার প্রতিভার রূপ। অনর্গল কবিতার ছন্দ মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে।
১৯৭৯ইং সনে কৃষি বিভাগে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করে সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন। চাকুরীকালীন সময়ে রাত জেগে রচনা করেন প্রতি নিয়মিত মুর্শীদি, মারফতি, পল্লীগীতি, বিষয় ভিত্তিক, দেশাত্ববোধক, হামদ-নাত ইত্যাদি। তাছাড়া কবিতা, ছড়া, জারী গান, নাটক, বিভিন্ন বিষয়ের উপর ফিচার। ক্ষণস্থায়ী এ জগৎকে তিনি অন্তর থেকে অনেক দূরে রেখে পরজগতের প্রতি নজর রেখেছেন বেশী। এ দুনিয়ার মূল্য শুধু ভোগ বিলাস আর বিশ্রাম খানা । তাই তিনি লিখেছেন এর পরকালের কর্মের প্রতি সকল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গেয়েছেন “একটি দমের নাই ভরসা কিসের বাহাদুরী, তোমার মনে কেন জাগে না ছাড়তে হবে এ ঘর বাড়ি”। মানব দেহের পঞ্চ ইন্দ্রকে নিয়ে গভীর চিন্তা করে মানুষ মানুষের সন্ধান করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মরহুম বাউল সম্রাট জালাল উদ্দিন খাঁ যেমনি ভাবে সৃষ্টি তত্ত্ব, নিগুর তত্ত্ব, আত্ব তত্ত্ব, পরাঘাটা, পঞ্চতত্ব, বিরহ তত্ব, সাধন তত্ব, বন্ধুয়া, বিচ্ছেদ, দেশতত্ব, বিচার, ভজন, ইত্যাদি বিষয়ে শত শত গান রচনা করে গেছেন তেমনি কবি তারামিঞাও বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি পড়তে পড়তে স্থান করে নিয়েছেন। তারামিঞার গানের বইগুলি পড়লেই বুঝা যায় বাউল সম্রাট জালাল উদ্দিন খাঁর গানের সাথে তার গানের অর্থ এবং ভাবের দিক দিয়ে কোন অংশে কম নয়।
ভক্তদের আকুলতা শিল্পী তারামিঞার সুস্থ, সুন্দর জীবন ফিরে পাক। আবারো তার দরাজ কন্ঠে কেঁপে উঠুক মঞ্চ, হাত তালিতে মুখরিত হোক কিশোরগঞ্জের সংগীতাঙ্গন। সে জন্য দেশবাসীর কাছে পরিবারের পক্ষে দোয়া চেয়েছেন।