প্রকৃতিকন্যা যমুনাকে আগ্রাসী, সর্বনাশী আবার কখনও রাক্ষসী নামেই অভিহিত করতো সিরাজগঞ্জবাসী। কেননা যুগ যুগ ধরে প্রমত্তা যমুনা তার ভয়াল থাবায় গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ নিজ উদরে গ্রাস করে নিয়েছে। তীরবর্তী মানুষগুলোকে করেছে নিঃস্ব। যমুনার আগ্রাসনে ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছিল ঐতিহ্যবাহী সিরাজগঞ্জ শহর। ভাঙন আতঙ্কে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছিল না প্রাচীন এই শহরটিতে। শহরটিতে কোনো শিল্প কারখানা, সরকারি-বেসরকারি বহুতল ভবন, মার্কেট, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর তেমন গড়ে উঠেনি। এ অবস্থায় শহর রক্ষায় ‘হার্ডপয়েন্ট’ নামে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এটি নির্মাণের পরই যমুনার অভিশাপমুক্ত হয় সিরাজগঞ্জ শহর। ‘হার্ডপয়েন্ট’ একদিকে আগ্রাসী যমুনাকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিয়েছে অপরদিকে হাজারও বিনোদনপ্রেমীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বিকেল হলেই প্রকৃতিকন্যা যমুনার নির্মল বাতাসে গাঁ ভাসিয়ে দিতে উদগ্রীব হয় মানুষ। তাই তো প্রতিদিন বিকেল হলেই হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে হার্ডপয়েন্টে। রুপালি যমুনাও তার স্নিগ্ধ সমীরণ ঢেলে মানুষের ক্লান্তি দূর করার পাশাপাশি প্রাণ জুড়িয়ে দেয় প্রকৃতিপেপ্রীদের। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, যমুনার ভাঙন থেকে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষায় নদীর তীর সংরক্ষণ পকল্প (সিরাজগঞ্জ হার্ডপয়েন্ট) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। সিরাজগঞ্জ শহরের মতি সাহেবের ঘাট থেকে কাজিপুর নৌকাঘাট পর্যন্ত ২.৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের প্রকল্পে ব্যয় হয় ৩৩৫ কোটি টাকা। ১৯৯৯ সালে এ বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হয়। যমুনা নদীর তলদেশে ১০০ থেকে ১২০ মিটার পর্যন্ত সিসি ব্লক দিয়ে গেঁথে তোলা হয় বাঁধটি। উপরিভাগে নির্মাণ করা হয়েছে ২০ মিটার প্রশস্ত পাকা সড়ক। বাঁধটি নির্মাণের পর থেকেই সিরাজগঞ্জসহ আশপাশের জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ এটি দেখতে আসেন একপর্যায়ে এটি মানুষের বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়ে উঠে। পরিপূর্ণ বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করতে পাউবো পর্যায়ক্রমে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এর মধ্যে রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য বসার আসন, রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধন। হার্ডপয়েন্টের দক্ষিণ অংশে জেলখানা ঘাট সংলগ্ন এলাকায় সিরাজগঞ্জ পৌরসভার তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে শিশুদের বিনোদনের জন্য শহীদ শেখ রাসেল স্মৃতি শিশু পার্ক। ২০২২ সালের ৭ মার্চ হার্ডপয়েন্টের মাঝামাঝি স্থানে স্থাপন করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বই ভাস্কর্য ‘মুজিব দর্শন’। যেখানে বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলোর প্রছদে বিশালাকৃতির ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। এ বছরের ১মে হার্ডপয়েন্টের উত্তরের অংশে স্থাপন করা হয় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ভাস্কর্য। এ ভাস্কর্য দুটি দর্শনার্থীদের আরও আকৃষ্ট করছে। এভাবেই প্রকৃতিকন্যা ধংসাত্মক যমুনার পাড়কে গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটনের স্পট হিসেবে। অপরদিকে হার্ডপয়েন্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সিরাজগঞ্জ শহর ও আশপাশের প্রায় সাত হাজার ৮০০ একর জমি ও তিন লাখ মানুষ যমুনার ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। সেই সঙ্গে লেগেছে অভূতপূর্ব উন্নয়নের ছোঁয়া। হার্ডপয়েন্ট নির্মাণের পরই ভাঙন আতঙ্ক কেটে যায় মানুষের। পরে একের পর এক গড়ে উঠছে বহুতল ভবন ও মার্কেট। প্রায় দুই যুগে অসংখ্য শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এতে সিরাজগঞ্জের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। নতুন-নতুন আধুনিকমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে উচ্চশিক্ষার পথকে সুগম করেছে। অপরদিকে হার্ডপয়েন্ট নির্মাণের ফলে দক্ষিণে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম গাইড বাঁধ ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বলেন, সিরাজগঞ্জবাসীর সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া যমুনা আজ আশির্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সূদুর পসারী পরিকল্পনায় ধ্বংসাত্মক যমুনাকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি লাখো মানুষের বিনোদনের জন্য বিশাল বিশাল স্পট তৈরি হয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধের পাশাপাশি ক্রসবারগুলোতে প্রতিদিন ভোর থেকেই মানুষের সমাগম হয়। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সব বয়সী মানুষেরা একটু প্রশান্তি পেতে আর যমুনার অপার সৌন্দর্য উপভোগ করেত ছুটে আসে এসব বাঁধ ও ক্রসবারে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রনজিত কুমার সরকার বলেন, যমুনার ভাঙন থেকে সিরাজগঞ্জ শহরকে রক্ষায় ১৯৯৯ সালে হার্ডপয়েন্ট নির্মাণ করা হয়। তখন থেকেই এটিকে বিনোদনের স্থান হিসেবে বেছে নেয় সিরাজগঞ্জবাসী। গত বছর হার্ডপয়েন্টের মাঝামাঝি স্থানে ‘মুজিব দর্শন’ নামে বঙ্গবন্ধুর বই ভাস্কর্য ও উত্তরের অংশে চলতি বছরের মে মাসে ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য। ফলে হার্ডপয়েন্ট এখন পরিপূর্ণ বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সালে যমুনার গতিপথ পরিবর্তনের লক্ষ্যে যমুনার বুকে আঁড়াআঁড়িভাবে চারটি ক্রসবার নির্মাণ করা হয়েছে। ক্রসবারগুলোর দৈর্ঘ্য এক থেকে প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটারের মতো। যেটা মূল বাঁধ থেকে লম্বালম্বিভাবে যমুনা নদীর মাঝখানে গিয়ে শেষ হয়েছে। শহরের উত্তরে শৈলবাড়ী ও খোকশাবাড়ী এলাকায় ১ ও ২ নম্বর ক্রসবার, মালশাপাড়া মহল্লায় ৩ নম্বর ও শহরের প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে পাইকপাড়া এলাকায় ক্রসবার ৪ এর অবস্থান। এসব বাঁধও এখন বিনোদনপ্রেমীদের প্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে।