মোঃ আল মামুন খান, সাভার প্রতিনিধি : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের অন্যান্য উপজেলার মত সাভার উপজেলা প্রশাসনও যখন করোনা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং করোনা সংকট মোকাবেলায় অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই হলুদ সাংবাদিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে নিজেদের পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠে স্থানীয় কিছু গণমাধ্যমকর্মী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সংকট মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ ম্লান করায় মত্ত হয়ে পড়েছে। আবারও সাজিয়েছিলো তারা সেই বাসন্তী নাটকের মঞ্চ। কিন্তু সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কর্মতৎপরতা এবং একনিষ্ঠ অনুসন্ধানী মনোভাবের কাছে হার মানতে হলো ওইসব হলুদ সাংবাদিকদের।
পাঠক, বাসন্তীর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? চলুন আরো একবার জেনে আসি। কুড়িগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত এলাকা চিলমারীর জেলে পাড়ার বাক প্রতিবন্ধী বাসন্তী ও তার কাকাতো বোন দুর্গতির জাল পরিহিত লজ্জা নিবারণের একটি ছবি ১৯৭৪ সালে ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। অভাবের তাড়নায় সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারছিল না বলে ছবিটিতে দেখানো হয়। সেই বহুল আলোচিত ছবির ফটোগ্রাফার ছিলেন ইত্তেফাকেরই নিজস্ব আলোকচিত্রী রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া থানার মহিপুরের আফতাব আহমদ। পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে ছবিটি ছিল সম্পূর্ণ সাজানো। বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ প্রমান করতে বাসন্তী ও দুর্গতিকে নিয়ে প্রকাশিত সাজানো সেই ছবিটি ছিল হলুদ সাংবাদিকতা ও নোংরা রাজনীতির খেলা। যে খেলার মুখোশ উম্মোচিত হলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক প্রতিবেদনও ছাপা হয় সেই সময়।
এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও ষড়যন্ত্রের তীর ছিলো জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যার বিরুদ্ধে। এবার ঘটনাস্থল ঢাকার সাভারের ব্যাংক কলোনী। ২১ এপ্রিল, মঙ্গলবার। সারাদেশ স্তব্ধ হয়ে শুনলো, এক মা অনাহারের কারণে এবং ত্রাণ না পেয়ে নিজের মাথার চুল ১৮০ টাকায় বিক্রী করে বাচ্চার জন্য দুধ কিনেছে! বিষয়টি বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন পোর্টালের কারণে মুহুর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। নড়েচড়ে বসে সাভার উপজেলা প্রশাসন। খবরটি জানার সাথে সাথে গতকাল আনুমানিক রাত ৯টায় সাভার উপজেলা পরিষদের সুযোগ্য চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব তৎক্ষনাৎ ওই মেয়েটির বাসায় ছুটে যান। এসময় তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আগামী ৬ মাসের শিশু খাদ্য কেনার জন্য নগদ ৬ হাজার টাকা অর্থ এবং ১৫ দিনের খাদ্য সামগ্রী উপহার তুলে দেন অসহায় সেই মায়ের হাতে।
পরের দিন ২২ এপ্রিল, বুধবার। সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজুর রহমান নিজেই তদন্তে নামেন বিষয়টির। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তিনি তদন্তের সারবস্তু নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন এবং একটি কল রেকর্ড সহ তিনটি ভিডিও ক্লিপস আপলোড করেন। বেরিয়ে আসে ২০২০ এর বাসন্তী কাহিনীর নাটক সাজানোর অপচেষ্টার ইতিবৃত্ত।
ইউএনও পারভেজুর রহমান তার স্ট্যাটাসে জানান, গতকাল (মঙ্গলবার) উপজেলা প্রশাসনের নিকট সর্বপ্রথম ঢাকা টাইমস সংবাদকর্মী ইমতিয়াজ বিষয়টি ফোনের মাধ্যমে অবহিত করেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে অনুরোধ জানানো হয় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ও জনগণের জন্য বিরূপ প্রভাব সৃষ্টিকারী সংবাদ তুলে না ধরার জন্য। এরপর বিষয়টি নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী সহ সাভার উপজেলা প্রশাসন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। বহির্বিশ্বেও মিডিয়ার কল্যাণে বিষয়টি ব্যপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়।
বুধবার (২২ এপ্রিল) এর ওই তদন্তে ফাঁস হয়ে যায় আসল ঘটনা। ইউএনও পারভেজুর রহমান উক্ত মহিলার নিকট জানতে পারেন, প্রায় দেড় মাস পূর্বে তিনি তার মাথার চুল বিক্রয় করেছেন এবং সাভার এলাকায় এসেছেন প্রায় দু’মাস পূর্বে। তৎপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে করোনা কালীন দুর্যোগের জন্য অর্থকষ্টে তিনি চুল বিক্রয় করেননি।
অথচ মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) সাভারের ব্যাংক কলোনী এলাকায় নান্নু মিয়ার টিনসেড বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকা অসহায় সেই মায়ের করুন কাহিনী নিয়ে ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করেন পারভেজ হাসান নামের একজন। মুহুর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় খবরটি।
ভিডিওতে ওই নারী জানান, সেখানে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছে পরিবারটি। বড় ছেলের বয়স আড়াই বছর ও ছোট ছেলের বয়স ১ বছর। স্বামী আগে মাটি কাটার কাজ করলেও পরে রিকশা চালাতে শুরু করে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাচ্চার খাবার নিয়ে সংকটে পরেন তারা। কোন উপায় না পেয়ে ২০ শে এপ্রিল, ২০২০ তারিখে হকারের কাছে ১৮০ টাকায় নিজের চুল বিক্রি করে শিশুর জন্য দুধ ও খাবারের জন্য দুই কেজি চাল কিনে আনেন।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, এখনও পর্যন্ত ত্রাণ বা কোন ধরনের সহযোগিতা পাননি অসহায় পরিবারটি। এই পরিবারটি আগে মিরপুরে থাকলেও গত এক মাস ধরে সাভারে বসবাস শুরু করেছেন।
কিন্তু সাভারের ইউএনও মহোদয়ের অনুসন্ধানী ভিডিও ক্লিপস এবং তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস থেকে স্পষ্ট হয়েছে, ওই মা ২০ এপ্রিল বাচ্চার দুধের জন্য তাঁর মাথার চুল কাটেন নাই; বরং তিনি তা প্রায় দেড় মাস পূর্বে বিক্রী করেছিলেন হকারের কাছে। আর সাভারে তিনি এসেছিলেন একমাস আগে না দুই মাস অর্থাৎ করোনা সংকটের আগে। এছাড়া, ঘটনাটি ভাইরাল হলে সাভার সদর রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই মাকে ত্রাণ সামগ্রী ও তার ব্যক্তিগত পক্ষ হতে অর্থ প্রদান করেন। ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানতে পারেন যে, জনৈক ওবায়দুর রহমান (অভি) নামক সাভারের এক ব্যবসায়ী ওই মাকে সর্বপ্রথম ত্রাণ সহযোগিতা করেছেন। তাহলে তিনি কোনো ত্রাণ পান নাই এবং এই কারণেই বাচ্চার দুধ কিনতে নিজের মাথার চুল ২০ এপ্রিল কেটেছেন- এসব ছিলো বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য যা শুধুমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ বিতরণ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই বিশেষ মহলের প্ররোচনায় কিছু অপ-সাংবাদিকের অপপ্রয়াস।
নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজুর রহমান প্রসঙ্গক্রমে জানিয়েছেন, চুল বিক্রয় করা বাংলাদেশে একটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম। স্থানভেদে চুলের বিক্রয় মূল্য ১০০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি।
এবিষয়ে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে, বিউটি পার্লার থেকে কিংবা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করা হয় নারীদের পরিত্যক্ত চুল। সেগুলো কারখানায় নিয়ে পরিষ্কার করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এরপর তা পাঠানো হয় ঢাকায়। সেখান থেকে রপ্তানি করা হয় মিয়ানমার, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে। এভাবে পরিত্যক্ত চুল রপ্তানি করেই লাখপতি হয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বদিকে বসবাসকারী প্রায় অর্ধশত চুল ব্যবসায়ী।
খুচরা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পরিত্যক্ত চুল সংগ্রহ করা হয় মূলত খুলনা ও বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে। এসব চুল লম্বায় ৮ থেকে ১২ ইঞ্চি। নকল চুল, পরচুলা, আসবাবপত্র, চুলসহ মাথার টুপি ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এসব চুল। প্রায় ৩০০ খুচরা ক্রেতার কাছ থেকে চুল কেনেন খুলনার ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন গড়ে এক মণ চুল সংগ্রহ করা হয়।
এসব কারণেই কোনো নারীর চুল কেটে তা বিক্রী করা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা না হলেও, করোনা পরিস্থিতিতে ঢাকার সাভারের রেডিও কলোনীতে অভাবের তাড়নায় বাচ্চার দুধ কেনাকে সামনে রেখে ওই মায়ের চুল কেটে বিক্রী করার ঘটনাটা নতুন করে বাসন্তী নাটক মঞ্চায়নেরই অপপ্রয়াস ছিলো যা সাভার উপজেলা প্রশাসন ভন্ডুল করে দিয়েছে এমনটা জানান সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজুর রহমান।
চুল বিক্রয় করে দুধ কেনার ঘটনা সম্পূর্ণ সাজানো এবং এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন বিভ্রান্তিমূলক উল্লেখ করে দেশের এই ক্রান্তিকালীন সময়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টায় যারা লিপ্ত, তদন্তপূর্বক তাদের পরিচয় বের করে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।