করোনা ভাইরাস মহামারি সবচেয়ে বিপর্যকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্য অঞ্চলগুলোতে অভিবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের। একই সঙ্গে তারা সংশ্লিষ্ট দেশে সরকার এবং নিয়োগকারীদের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যারা দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের অবস্থা ভয়াবহ। তাদেরকে খাদ্যের অভাবে অনাহারেও থাকতে হচ্ছে। ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া রয়েছে আরো সব বিপর্যয়কর অবস্থা। বাংলাদেশের কমপক্ষে এক কোটি মানুষ বা প্রতি ২০ জনের মধ্যে প্রায় একজন বিদেশে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। বিদেশে শ্রমিক পাঠায় যেসব দেশ তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ শ্রমিক পাঠানোর দেশের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ষষ্ঠ।
এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যে। তার মধ্যে আবার প্রায় ২০ লাখ সৌদি আরবেই। অনলাইন ওয়ার্ল্ড স্যোশালিস্ট ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বাংলাদেশি অনেক পত্রিকাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, আক্রান্তের দিক দিয়ে তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশি অভিবাসীরা। ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৮৬টি দেশে কমপক্ষে ৭০ হাজার বাংলাদেশি করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। ২১ শে জানুয়ারি একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়, ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ টি দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট ২৩৩০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছেন। করোনা ভাইরাসে মৃত এসব মানুষের মধ্যে এক চতুর্থাংশই সৌদি আরবে। ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে এত বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসী মারা যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, ফ্রি চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা। ২০ শে জানুয়ারি প্রকাশিত এক রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ওমানে কর্মরত বাংলাদেশি একজন চিকিৎসক বলেছেন, আমরা দেখেছি বাংলাদেশি গৃহপরিচারিকারা তাদের নিজেদের অর্জিত অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা নিয়োগকারীদের যথেষ্ট সহানুভূতি বা উদারতা পান না।
রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিনামূল্যে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার সুযোগ আছে সব অভিবাসীর। এক্ষেত্রে তাদের বসবাসের বৈধতা যা-ই হোক না কেন। যেসব অভিবাসীর কাছে বৈধ কাগজপত্র নেই তাদেরকেই চিকিৎসা দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু তারা এসব চিকিৎসা নিতে যাননি। কারণ, গ্রেপ্তার করে তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে এমন ভয়।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে স্বাস্থ্যখাতে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক খাতে ভয়াবহ এক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এতে গত বছর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যা চার থেকে আটগুন বেশি। ফলে গত বছর বাংলাদেশি গেস্ট ওয়ার্কারের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ। আগের বছরের তুলনায় নাটকীয়ভাবে কমে গেছে এই সংখ্যা। আগের বছরগুলোর গড় ছিল এক্ষেত্রে ৭ লাখ এবং ৮ লাখ। বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস এবং মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্স ইউনিটের মতে, গত বছর এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে শতকরা প্রায় ২৭ ভাগ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। খ-কালীন কাজ কমে গেছে শতকরা ২৬ ভাগ। দেশে ফিরে এসেছেন যেসব অভিবাসী তাদের শতকরা প্রায় ৬৭ ভাগের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। শতকরা ৬২ ভাগ শ্রমিক তাদের জমানো সঞ্চয় এবং অন্যান্য সম্পদ ফেলে এসেছেন। গত জুলাইয়ে মালদ্বীপে বাংলাদেশ হাই কমিশনার স্বীকার করেছেন যে, অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক তাদের বেতন ও অন্যান্য পাওনা পাননি।
সৌদি আরবে গৃহকর্ম করতেন ৪০ বছর বয়সী ফিরোজা বেগম। তিনি করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন। পটুয়াখালিতে গ্রামের বাড়ি ফেরার জন্য ১৪ বছর ধরে তিনি সঞ্চয় করেছিলেন। তা খরচ করে ফেলেছেন। তাকে ৬ মাসের পাওনা দেননি নিয়োগকর্তা। বাংলাদেশি শ্রমিকদের মারাত্মক কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়। কখনো করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপদ নয় এমন স্থানেও কাজ করতে হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওমানে বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীকে মাসে গড়ে মাত্র ২৩৪ ডলার বেতন দেয়া হয়। কিন্তু ফিলিপাইনের গৃহকর্মীদের দেয়া হয় ৪১৬ ডলার। ভারতীয় এবং শ্রীলঙ্কান গৃহকর্মীদের দেয়া হয় ৩১২ ডলার। কম বেতনের বাংলাদেশি শ্রমিকরা মাঝে মাঝেই এজেন্টের হাতে হয়রানির শিকারে পরিণত হয়ে থাকেন। নাজমা নামে একজন নারী শ্রমিককে পাঠানো হয়েছিল সৌদি আরবে। স্থানীয় ব্রোকারের মাধ্যমে ২০১৮ সালে তাকে হাসপাতালে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরিবারের মতে, তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এক ব্যক্তির বাড়িতে। সেখানে তাকে নির্যাতন করা হয়। যৌন নির্যাতন করা হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়। করোনা মহামারির আগেই বাংলাদেশি শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। ২০০৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এমন ৩৩ হাজারের বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছেন বিদেশে। গত বছর কমপক্ষে ৬০ জন নারী গৃহকর্মীর মৃতদেহ দেশে এসেছে। এর মধ্যে একটি ১৪ বছরের বালিকা উম্মে কুলসুমও ছিল। তাকে সেপ্টেম্বরে তার সৌদি আরবের বাড়ির মালিক নির্যাতন করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মদিনার কাছে হেরাত মার্কেটের বিপরীতে একটি সোফার কারখানায় আগুনে পুড়ে কমপক্ষে ৬ বাংলাদেশি শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়, বিদেশফেরত এসব শ্রমিকদের কোনো ত্রাণ সহায়তা দেয়নি বাংলাদেশ সরকার। ফলে তারা দেশে ফিরে ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন। এমনকি অনেকে অনাহারেও দিন কাটাচ্ছেন।