গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের তেমন সুবিধা পাচ্ছে না ভূমিহীনরা। কাজে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মুখ থুবরে পড়েছে প্রকল্প দু’টিতে। জানা গেছে, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ভূমিহীনদের মাথা গোঁজার ঠাই করে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আশ্রয়ণ ও গুচ্ছগ্রাম নামে দু’টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু কৌশলে প্রকল্প দু’টি এমন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে যে, সেখানে থাকার মত কোন পরিবেশ নেই। গোবিন্দগঞ্জের প্রায় ২০টি স্থানে নির্মিত প্রকল্প দু’টির সবগুলোই নদীর ধারে অবস্থিত। নির্মিত ঘরগুলো নিম্ন মানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি করার কারণে ব্যবহার না হতেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রকল্পের ঘরগুলো যাদের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তারা সেখানে যেতে অনিচ্ছুক। আমিরুল ইসলাম নামে একজন জানালেন, ঘরগুলো এখনই ধ্বসে পড়ছে। নদীর ধারে হওয়ায় সেখানে বসবাসের মতো অবস্থা নেই। সরকারি অর্থ হরিলুটের জন্যই এ প্রকল্পগুলো করা হয়েছে। প্রকল্প দু’টির মধ্যে গুচ্ছ গ্রামের ৯শ’ টি ঘরের বিপরীতে ১৩ কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা এবং আশ্রয়ণের ৭শ’ ৮০টি ঘরের বিপরীতে ১৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মাটি ভরাট বাবদ প্রায় ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। মোট প্রকল্প ব্যয় ৪৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও জনগণের তেমন কোন উপকারে আসছে না প্রকল্প দু’টি থেকে। এতে শুধু লাভবান হচ্ছে প্রকল্পের সাথে জড়িত কর্তা ব্যক্তিরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত প্রকল্প এলাকায় কোন লোকজন বাস করছে না। ল্যাট্টিন সহ ঘর গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে খাবার পানির কোন ব্যবস্থা নেই। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে নির্মিত প্রত্যেকটি প্রকল্পেরই একই হাল। উপজেলার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের ফুলহার গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১২০টি ও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ১৩০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্প দুটি থেকে ২০৭টি ঘর হস্তান্তর করা হলেও সেখানে গুটিকয়েক পরিবার বসবাস করছে। বাকীরা এখনো সেখানে আসেনি। একই ইউনিয়নের ফকিরগঞ্জ ১২০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে এখানে ২০ থেকে ২৫টির মতো পরিবার বসবাস করছে। এছাড়া বেতারা গ্রামে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ৭০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে ৪০টি পরিবার বসবাস করছে। দরবস্ত ইউনিয়নের নলডাঙ্গা গোবিন্দপুর গ্রামে আশ্রয়ণের ৩০টি গোসাইপুর গ্রামে গুচ্ছগ্রামের ৩০টি ঘর নির্মাণ করে সবগুলো হস্তান্তর করা হলেও সেখানে মাত্র কয়েকটি পরিবার বসবাস করছে। এরপরও হরিলুটের ধান্দায় আবারো নতুন করে গুচ্ছগ্রামের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে যা চলমান রয়েছে। হরিরামপুর ইউনিয়নের ধুন্দিয়া গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০টি ঘরের মধ্যে ৪০টি হস্তান্তর করা হয়েছে। এখানেও একই চিত্র। মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের পান্থামারী গ্রামে আশ্রয়ণের ৬০টি ও বালুয়া গ্রামে ১২০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৬০টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। ফুলবাড়ি ইউনিয়নের খানসাপাড়া গ্রামে আশ্রয়ণের ১১০টি ঘর নির্মাণ করে ৬০টি হস্তান্তর করা হয়েছে। রাখালবুরুজ ইউনিয়নের পার সোনাইডাঙ্গা গ্রামে আশ্রয়ণের ১২০টি ঘর নির্মাণ হলেও মাত্র কয়েকটি পরিবারকে সেখানে বসবাস করতে দেখা গেছে। সাপমারা ইউনিয়নে দুধিয়া গ্রামে আশ্রয়ণের ৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে সবগুলো ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। একই ইউনিয়নের চক রহিমাপুর গ্রামে ১৩০টি ঘর গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প থেকে তৈরি করা হয়েছে এরমধ্যে ৪০টি পরিবারকে সেখানে বসবাস করতে দেখা গেছে। তালুককানুপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর ও তাজপুর গ্রামে গুচ্ছগ্রামের ২২০টি ঘর নির্মাণ করে সবগুলো হস্তান্তর দেখানো হলেও সেখানে মোট ঘরের অর্ধেক পরিমাণ ঘর অব্যবহৃত রয়েছে। এ প্রকল্প গুলোর সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ার পরেও আবারো সাপমারা ইউনিয়নের নরেঙ্গাবাদ গ্রামে গুচ্ছগ্রামের ৬০টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। হরিরামপুর ইউনিয়নের ধুন্দিয়া গ্রামে গুচ্ছগ্রামের ১০০টি, রাখালবুরুজ ইউনিয়নের রাখালবুরুজ গ্রামে গুচ্ছগ্রামের ৬০টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। কাটাবাড়ি ইউনিয়নের ফুলহার গ্রামে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের মাটি ভরাট কাজ চলছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার আশ্রয়ণ ও গুচ্ছগ্রামের প্রকল্পগুলো সবগুলোই অনুপযুক্ত জায়গায় নির্মিত হওয়ায় সরকারের শুধু অর্থ ব্যয়ই হচ্ছে। সাধারণ জনগণ এর কোন সুফল পাচ্ছে না। শুধু প্রকল্পের সাথে জড়িতরাই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন সেনাবাহিনী আর গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পটি একটি কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে যার সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সদস্য সচিব সহকারী কমিশনার (ভূমি) তিনি আরো জানান, ইউনিয়ন পরিষদ খাস জমি নির্বাচন করে তার বিপরীতে ভূমিহীন দেখিয়ে প্রকল্প পাঠায় সেটি ভূমি অফিস যাচাই-বাছাই করেন। প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার পরেই কাবিখা প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রমিক দিয়ে মাটি কাটার কথা থাকলেও ড্রেজার দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ থেকে বালু উত্তোলন করে মাটি ভরাট কাজ করছেন। এছাড়া এ অফিসের আর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে এর চেয়ে আর কোন তথ্য নেই তার কাছে। এ বিষয়ে বিশদ জানার জন্য তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট থেকে জেনে নেয়ার পরামর্শ দেন। এনিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রামকৃষ্ণ বর্মনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কাজে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। এমতবস্থায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত সহ দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আশু জরুরী বলে সচেতন মহল মনে করেন।