রোগী হয়রানি, নরমাল ডেলিভারীতে অর্থ আদায়, সিজার বানিজ্য, কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত না থাকা, অযথা পরীক্ষা (টেস্ট) দিয়ে কমিশন আদায়সহ নানান অনিয়ম ও দুর্ণীতিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে লক্ষ্মীপুর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত এ কেন্দ্রে টাকা ছাড়া সেবা মেলে না বলে রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ। কৌশলে রোগীদেরকেও বিভিন্ন ক্লিনিকে যেতে বাধ্য করছেন বলে রোগী ও অভিভাবকরা জানান। ডাক্তার, কর্মচারী সকলের এ যেনো এক রমরমা ব্যবসা। গণমাধ্যমকর্মী সরেজমিনে দেখেন, লক্ষ্মীপুর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা (ভিজিটর) রৌশন আরা নিজেই দেখেন রোগী। সরকারি নির্দিষ্ট স্লিপে ওষুধ পত্র না লিখে ওষুধ কোম্পানীর প্যাডে দিচ্ছেন পরিক্ষা-নিরিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা। তবে চিকিৎসায় সকল রোগীদেরকে ইউনানী (জি-এইচ) নামে একটি ওষুধ লিখে থাকেন তিনি। ওই ওষুধ লিখায় রীতিমতো কমিশন পেয়ে থাকেন এ ভিজিটর। সরকারি ভাবে গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভিটামিন, আয়রণ, ক্যালসিয়াম অন্যান্য বেশিরভাগ ওষুধ সরবরাহ থাকলেও বাহিরের ওষুধ লিখে কোম্পানীদের কাছ থেকে সুবিধা নেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। নিজের দেওয়া পরিক্ষা (টেস্ট) নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে না করলে সেই রোগীর রিপোর্ট না দেখে ওই রোগীর সেবা বন্ধ করে দেন। এ যেন এক মহা অনিয়ম ও স্বেচ্ছাসারিতা। মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রের সকল ভিজিটরদের বিরুদ্ধে একই রকম অভিযোগ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা ও যোগসাজসে এসব অনিয়ম নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে বলেও জানা যায়। আর তাদের এসব অনিয়মের প্রতিবাদ বা গনমাধ্যমকর্মীরা খোঁজ নিতে গেলেও হয়রানীর শিকার হতে হয়। জানা যায়, গত ১০ বছরের বেশিও সময় ধরে লক্ষ্মীপুর মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রে ভিজিটর হিসেবে কর্মরত আছেন রৌশন আরা। তার স্বামী ফারুক আহমেদ ছিদ্দিকী পরিবার পরিকল্পনা জেলা অফিসের উচ্চমান সহকারী। স্বামী স্ত্রী একই বিভাগে চাকুরী করার কারণে এবং টেস্ট বানিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের কথা এখন রোগীদের মুখে মুখে ও মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রের আশে পাশে সকলের মুখে। অন্যান্য ভিজিটর বা ডাক্তার, নার্সরা কোয়ার্টার বরাদ্ধ না পেলেও তিনি থাকেন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এলাকার কোয়ার্টারেই। সরেজমিনে জানা যায়, ডাক্তার দেখাতে রোগীরা ৪০ থেকে ১০০ টাকা ফি দিয়ে টিকেট কেটে প্রাথমিক চেক আপের জন্য ভিজিটর রৌশন আরার কাছে গেলে ডাক্তার না হয়েও তিনি একটি সাধারণ স্লিপে আল্ট্রাসনোগ্রাফী, ব্লাড গ্রুপ ও হিমোগ্লোবিনসহ অন্যান্য টেষ্ট করার জন্য বলেন। এসব টেষ্ট তারই দেখিয়ে দেওয়া নির্দিষ্ট ল্যাব বা প্যাথলজীতেই করাতে হয়। না হয় ওই টেষ্ট দেখেন না তিনি। অভিযোগ আছে একজন রোগী ১ সপ্তাহে ২ বার গেলেও তাকে একই টেষ্ট করতে হয়। এসব টেষ্ট করানোর জন্য হাসপাতালের স্টাফ দিয়ে রোগীদের প্যাথলজীতে নেওয়া হয় বলেও জানান একাধিক প্যাথলজী কর্তৃপক্ষ। প্যাথলজী থেকে দিনশেষে ২০০-৩০০ টাকা হিসেবে কমিশন নেন রৌশন আরা বেগম। শারমিন আক্তার নামে এক রোগী অভিযোগ করে বলেন, তাকে নির্দিষ্ট প্যাথলজীতে টেষ্ট করানোর জন্য বলেন রৌশন আরা। অন্য প্যাথলজীতে টেষ্ট করালে তার রিপোর্ট দেখেননি, তাকে ব্যবস্থাপত্রও দেননি। ৩ মাসের মধ্যে ২ বার ব্লাড গ্রুপিং থাকার পরও তাকে নতুন করে ব্লাড গ্রুপ টেষ্ট করতে দিয়েছে। ঝর্ণা আক্তার নামে আরেক রোগী বলেন, ডাক্তারকে না দেখিয়ে রৌশন আরাই সকল চিকিৎসা করে থাকেন। শরীরের কোন সমস্যার কথা বললেও সকল রোগীকে একই ওষুধ লিখেন তিনি। টেস্ট এর পর রিপোর্ট না দেখেই ওষুধ লিখে দেন। জাহানারা আক্তার নামে এক প্রসূতী রোগী অভিযোগ করেন, সরকারিভাবে সকল ওষুধ সরবরাহ থাকলেও রৌশন আরা সাধারণ স্লিপে বাহিরের কোম্পানীর ওষুধ লিখেন। এসবের প্রতিবাদ করলে উল্টো হেনস্থার শিকার হতে হয়। রহমান ব্যাপারী নামে এক রোগীর স্বামী রৌশন আরার দেওয়া স্লিপের কয়েকটি ওষুধ কিনতে গেলে দোকানে এগুলোকে নিম্নমানের ও অনঅনুমোদিত ওষুধ বলেছেন বলে অভিযোগ করেন। অথচ সরকারিভাবে সকল ওষুধ সরবরাহ করা হয় বলেন তিনি। ডাক্তারদের কাছে রোগীদের না পাঠিয়ে নিজেই চিকিৎসা দেন। জটিল ও নরমাল রোগী সকলেরই একই ওষুধ লিখেন। তাহলে টেষ্ট এর প্রয়োজন কি ছিল। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রৌশন আরা বলেন, সরকারি ওষুধ সাপ্লাই নাই। তবে ভুল করে কলমের খোঁছায় একই ওষুধ সকল রোগীর জন্য লিখে ফেলেছি। ওষুধগুলো কোন কোম্পানী বা গ্রুপের জানতে চাইলে তা তিনি বলতে পারেননি। টেষ্ট করানোর জন্য বলতে বা লিখতে পারেন কিনা সে বিষয়ে তিনি বলেন ভিজিটররা সকল কিছুই পারেন। ওষুধ ও টেষ্ট এর মাধ্যমে বানিজ্য এর বিষয়ে তাকে বললে তিনি কোন উত্তর দেননি। এসব বিষয়ে মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা: হ্যাপী কর্মকার এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেননি। পরে ১২ আগস্ট দুপুরে মুঠোফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি। রৌশন আরার টেষ্ট বানিজ্য, বাহিরের নিম্নমানের ওষুধ লেখা ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ডা: আশফাকুর রহমান মামুন বলেন, ভিজিটররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারেন। তবে কোন টেষ্ট করানোর জন্য বলতে পারবেননা। তারা রোগীদেরকে সরকারী ওষুধ লিখে দিবেন কোনভাবেই বাহিরের ওষুধ লিখতে পারবেননা। নিম্নমানের ওষুধ লিখে কমিশন ও টেষ্ট করিয়ে প্যাথলজী থেকে কমিশন আদায় এর বিষয়ে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোন ভাবেই অন্যায় ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবেনা বলেও জানান তিনি। মা ও শিশুদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষে স্থাপিত সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি আরো বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্ণীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত এখন। এখানকার ডাক্তারদের সাথে প্রভাবশালী মহলের সম্পর্ক থাকায় কেউ এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেনা বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে রোগী ও স্থানীয়রা। চলবে…