পানির উপর চাষ হয় বলে এই ফলের নাম বলা হয় পানিফল, যাকে স্থানীয় ভাষায় সিংড়া,পানি শিঙাড়া বলেও অবিহিত করা হয়। নানা পুষ্টি গুণে ভরপুর এই ফলটি খেতেও অত্যন্ত সুস্বাদু। কাঁচা এবং সিদ্ধ করে দুই ভাবেই খাওয়া যায়। পানিফল শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরাও খেতে পছন্দ করেন। আর খেতে সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় চাহিদাও বেশি।পানিফল কচি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ এবং পরিপক্ব হলে কালো রং ধারণ করে। ফলটির পুরু নরম খোসা ছাড়ালেই পাওয়া যায় হৃৎপিণ্ডাকার বা ত্রিভুজাকৃতির নরম সাদা শাঁস। অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন পানিফল চাষে আগ্রহ বাড়ছে বগুড়ার চাষীদের। এই পানিফল জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও বিক্রি করা হচ্ছে এ ফল। বগুড়ার খাল-বিল জলাশয়জুড়ে এখন শোভা পাচ্ছে পানিফলের গাছ। অন্য ফলের পাশাপাশি পানিফল বাজার দখল করতে শুরু করায় চাহিদাও বাড়ছে এই ফলের। এই পানিফল চাষ শুরু হয় ভাদ্র-আশ্বিন মাস থেকে আর ফল সংগ্রহ করা হয় অগ্রহায়ণ-পৌষ মাস পর্যন্ত। এই জেলায় পানিফলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে এক দশক আগে থেকে। বগুড়া সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পূর্বে দোবিলা বিলে স্থানীয় কয়েকজন চাষীরা পানিফলের চাষ করছেন । এছাড়া বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, গাবতলী, নন্দীগ্রাম, ও ধুনট উপজেলায় পানিফল উৎপাদনে সফলতা পাওয়ায় চাষিরা অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষি অফিস থেকে চাষাবাদ পদ্ধতি শিখে পতিত জলাশয়ে পানিফল চাষ করছেন। নিচু পতিত জমি এবং বিল-জলাশয়ে মৌসুমি ফসল হিসেবে পানিফল চাষ অধিক লাভবান হচ্ছে। বগুড়ার চেলোপাড়া চাষী বাজারে এই পানিফল বিক্রি করতে আসে বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষিরা। এখানে প্রতিদিন সকালে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ মন পর্যন্ত পানিফল বিক্রি হয় থাকে। এই ফলের চাষও যেমন বাড়ছে তেমন বাজারে এই ফলের দামও ভালো পাচ্ছে চাষিরা। আর ভালো দাম পেয়ে মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে চাষীদের। বগুড়া শহর ও বিভিন্ন উপজেলার বাজারে খুচরা বিক্রেতারা প্রতি কেজি পানি ফল বিক্রি করছেন ৪০টাকা কেজি দরে। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুন হওয়ায় পরিবারের জন্য অনেকেই কিনছেন এই ফল। স্থানীয় বাজার ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এসে ফল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বগুড়া সদর উপজেলার সাবগ্রাম দক্ষিণপাড়ার পানিফল চাষী আনছার আলী, আব্দুর রহিম, মোহাম্মদ মুসা ও শফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা চারজন মিলে দোবিলা বিলে ১৬ বিঘা জমিতে পানিফলের চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে তাদের খরচ হয়েছে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। ১ থেকে দেড় মাসে প্রতি বিঘা থেকে ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পানিফল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশাবাদী। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ মন করে পানিফল বাজারে বিক্রি করেন। পাইকারি বাজারে প্রতি মন পানিফল বিক্রি করেন ৮৫০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা। খরচ কম হওয়ার তাদের মতো বাণিজ্যিকভাবে পানিফল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই। আগামী বছর তারা আরও বেশি জমি নিয়ে চাষ করবে বলে জানান। বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় গত বছর জেলায় ৪১ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হয়েছে। চলতি বছরে একটু বেশি পরিমান জমিতে পানি ফল চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যা থেকে ১ হাজার ২৩১ মেট্রিকটন ফল উৎপাদন হবে। এ পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ৩১ হেক্টর জমি। কর্তন হয়েছে ৯ হেক্টর জমি। পানিফলের পাইকারি ব্যবসায়ী খাইরুল ইসলাম জানান, চাষের মৌসুম আসার আগে তিনি চাষির মাঝে অর্থ বিনিয়োগ করেন। পরে ফলন আসার পর বাজারদর অনুযায়ী উৎপাদিত ফসল কেনেন। এভাবে ৮-১০ বছরের বেশি সময় তিনি পানিফল ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় এ ফল সরবরাহ করেন। বর্তমান জেলার বাইরে বাজারভেদে পাইকারি দরে পানিফল বিক্রি করেন। হায়দার আলী নামে আরেক চাষি বলেন, কয়েক বছর ধরে পানিফল চাষ করে আসছি। এ বছর ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। বিঘাপ্রতি ১৮-২০ মণ ফলন পাচ্ছি। প্রথমে মানুষের মাঝে তেমন সাড়া পাওয়া না গেলেও দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। অন্যান্য ফসলের চেয়ে এ ফলের খরচ অনেক কম। পরিচর্যাও তেমন করতে হয় না। তিনি আরো বলেন, ফল চাষের জমি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডোবা, বদ্ধ জলাশয় বা মাছের ঘেরের সুবিধাজনক স্থান। সামান্য লবণাক্ত ও মিষ্টি পানিতে পানিফল চাষ করা যায়। বগুড়া জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফরিদুর রহমান জানান, গত বছরের তুলনায় পানিফল চাষ বেড়েছে। চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। ফলটি চাষাবাদে খরচ কম ও অল্প পরিশ্রমে বেশ লাভবান হওয়ায় প্রতি বছর আগ্রহ বাড়ছে জেলার পানিফল চাষিদের। ফলটি জেলার গাবতলী, নন্দীগ্রাম, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় বেশি চাষ হয়ে থাকে। অন্য ফসলের চেয়ে পানিফল চাষে কষ্ট কম হয়। কীটনাশক ও সার কম ব্যবহার হওয়ায় এটি পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার হাওয়ায় সবাই পছন্দ করেন।