ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে অবিরাম বর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে জেলার জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গত দুই দিন ধরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এ উপজেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন উপজেলার অনেক উচু স্থানেও পাহাড়ি ঢলের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় সবকটি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী উপজেলা জৈন্তাপুরে সারি গোয়াইন ওয়াপদা বেড়িবাঁধ প্রকল্পের চারটি অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তবে স্থানীয়রা গত দুইদিন ধরে ভাঙ্গন মেরামতে কাজ করেছে। তবে পাহাড়ি ঢলের কারণে জৈন্তাপুর উপজেলা সদরের বাসাবাড়িতেও পানি উঠেছে। বুধবার রাত ১০টা থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় স্থানীয়রা উদ্ধার তৎপরতায় রাতভর কাজ করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে পানি কিছুটা কমার খবর পাওয়া গেছে।এসব উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্রে খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষজনকে তাদের গবাদি পশুসহ ভিড় করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন এলাকায় প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করতে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে। এছাড়া স্থানীয় পুলিশ-বিজিবিসহ রাজনৈতিক কর্মীরা মাঠে রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানির কারণে জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলাগুলোর বেশ কয়েকটি রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেট তামাবিল সড়কের ওপর দিয়ে যানবাহনের পাশাপাশি নৌকা চলতে দেখা গেছে। অনেক সড়কে যান-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বুধবার রাত থেকে গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ ইতোমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান ভোরের কাগজকে জানান, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেটের সীমন্তবর্তী চার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা অব্যাহত আছে। পরিস্থিতির ভয়াবয়তা বিবেচনায় সেনাবাহিনীর সহযোগীতা চাওয়া হয়েছে। তারা বৃহস্পতিবার ভোর থেকে উদ্ধার তৎপরতায় মাঠে নেমেছে। বন্যার্ত মানুষদের জন্য কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৩৫টি, গোয়াইনঘাটে ৫৬টি, জৈন্তাপরে ৪৮টি ও কানাইঘাটে ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলাগুলোর বেশিরভাগ বাড়িঘরের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গোয়াইনঘাট উপজেলার সারিঘাট-গোয়াইনঘাট, গোয়াইনঘাট-রাধানগর-জাফলং ও সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক প্লাবিত হওয়ায় রাস্তা দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বাকি উপজেলাগুলোতেও সড়ক ডুবু ডুবু অবস্থায় রয়েছে। গোয়াইনঘাট থেকে আমাদের প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। উপজেলার সদরসহ প্রায় সব গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন। টানা তিনদিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে সারি ও পিয়াইন নদী দিয়ে আসা ঢলে উপজেলার সবকটি ইউনিয়নের ৯০ ভাগ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এলাকাবাসী জানান, গত মঙ্গলবার সকাল থেকে একটু একটু করে পানি বাড়তে শুরু করে। আগে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। বুধবার দুপুরের পর থেকে সারী ও পিয়াইন নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ৯০ভাগ ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। উপজেলার পূর্ব জাফলং, পূর্ব আলীরগাঁও, পশ্চিম আলীরগাঁও, মধ্য জাফলং, পশ্চিম জাফলং, সদর, রস্তমপুর, বিছনাকান্দি, তোয়াকুল, লেঙ্গুড়া, ডৌবাড়ী, নন্দীরগাঁও ইউনিয়ন সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। ফতেহপুর ইউনিয়নের আংশিক প্লাবিত হয়েছে। সারী-গোয়াইন, গোয়াইন-সালুটিকর সড়কসহ সবগুলো সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এদিকে, বিদ্যুৎ না থাকায় মানুষ অন্ধকারে রয়েছেন, এবারের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভাঙবে বলে শঙ্কায় স্থানীয় বাসিন্দারা। অনেক জায়গায় পানিবন্দি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। এছাড়া- ফিসারির মাছ, রোপা আউশ, আউশের বীজতলা এবং সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পিআইও শীর্ষেন্দু জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার তথ্য অনুযায়ী পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সে.মি ওপর দিয়ে, গোয়াইন নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সে.মি ওপর দিয়ে এবং সারী নদীর পানি বিপৎসীমার ১১০ মে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। উপজেলায় বিভিন্ন ইউনিয়নে ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জৈন্তাপুর থেকে আমাদের প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম বাবু জানান, জৈন্তাপুরে দ্বিতীয় দিনে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলা সদরের বেশিরভাগ বাসা বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকারা ধারন করেছে। সিলেট তামাবিল সড়কেরর বেশ কয়েকটি জায়গা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সড়কের ওপর দিয়ে নৌকা চলতে দেখা গেছে। স্থানীয় প্রশাসন আশ্রয় কেন্দ্র খুললেও পানি বাড়ায় আশ্রয়কেন্দ্রেও মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উপজেলার সারী, বড় নয়াগাং ও রাংপানি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। বুধবার রাতে উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে। সারি গোয়াইন ওয়াপদা বেড়িবাঁধ প্রকল্পের চারটি অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বুধবার রাত ১২টায় জৈন্তাপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাহেদ আহমদ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন ‘কেউ নিজপাট ময়নাহাটি মাঝের টুকে একটি নৌকা পাঠান, কিছু লোক আটকা পড়েছেন।’ এভাবে আটকে পড়াদের উদ্ধারে নানা আকুতি ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সরেজমিন দেখা যায়, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন নিজপাট, জৈন্তাপুর ও চারিকাটা ইউনিয়নের বাসিন্দারা। এদিকে, প্রশাসনের কর্মকর্তারা বন্যা পরিস্থিতির খোঁজ খবর রাখছেন। নিজপাট লামাপাড়া, বন্দরহাটি, ময়নাহাটি, জাঙ্গালহাটি, বড়খেল, মেঘলী, তিলকৈপাড়া, ফুলবাড়ী, নয়াবাড়ী, হর্নি, বাইরাখেল, গোয়াবাড়ী, ডিবির হাওর, ঘিলাতৈল, মুক্তাপুর, বিরাইমারা হাওয় হাওর, খারুবিল, লামনীগ্রাম, কাটাখাল, বাউরভাগ, চাতলারপাড়, ডুলটিরপাড়, ১নম্বর লক্ষ্মীপুর, ২নম্বর লক্ষ্মীপুর, আমবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, কাঁঠালবাড়ী, নলজুরী, কেন্দ্রী, থুবাং, কালিঞ্জি, লালা, তুমইর, শেওলারটুক, বাওন হাওর প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার সর্ববৃহৎ সারী, বড় নয়াগাং ও রাংপানি নদীর পানি বিপৎসীমার দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আমরা বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং নিম্নাঞ্চলের জনসাধারণ ও গবাদি পশু নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনার কাজ করছি। এছাড়া, জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, ১৩টির মধ্যে ১২টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসা লোকজনের জন্য শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছি এবং মাঠে আছি।