চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ এলাকায় ৬৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বাস্তবায়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। যমুনা নদীর পাড়ে ২১৪ একর জমিতে স্থাপিত এই বিদ্যুৎকেনদ্র থেকে আগামী মে মাসে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর উত্তর পাড়ে পতিত চরের জমিতে সারিবদ্ধ ও সুউচ্চ ২৭ হাজার পিলারে বসানো হয়েছে দেড় লক্ষাধিক সোলার প্যানেল। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সোলার প্যানেলের নিচের জমি এখন সম্পূর্ণ কৃষিবান্ধব; করা যাবে মৌসুমি ফসলের আবাদ। বাংলাদেশ-চায়না রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি (বিসিআরইসিএল) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প ব্যয় ৮৭ দশমিক ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (চুক্তিকালীন ডলারের বিনিময় হার ১০৫ টাকা হিসাবে প্রায় ৯২১ কোটি টাকা)। যৌথ অর্থায়নে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৫০ শতাংশ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। অর্ধেক মালিকানা চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি)। ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (পিপিই) এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (আইএ) সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা (ইউনিট) বিদ্যুতের দাম ১০ দশমিক ২০ ইউএস সেন্ট। ডলারের বর্তমান বিনিময় হার ১১০ টাকা হিসাবে প্রতি ইউনিটের দাম ১১ দশমিক ২২ টাকা। ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চীনা কনসোর্টিয়াম অব প্যারিওশেন-ফেডি-সিনোহাইড্রো। সংস্থাটির সঙ্গে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এ-সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। কারিগরি পরামর্শক হিসেবে রয়েছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান জেডটেনকো। দেশে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের সঙ্গে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিসিআরইসিএল গঠন করে সরকার। প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক বিসিআরইসিএলের প্রথম বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী তানবীর রহমান বলেন, এপ্রিলের শেষ দিকে সব প্যানেল স্থাপনের কাজ শেষ হবে। কন্ট্রোল বিল্ডিং, অফিসার ডরমিটরি, রেস্টহাউস, নিরাপত্তা ভবনসহ অন্যান্য কাজও শেষ পর্যায়ে। এনডব্লিউপিজিসিএলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাইমেনুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। আশা করছি, এপ্রিলের শেষের দিকে সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক থাকলে মে মাসে বাণিজ্যিক উৎপাদনে (সিওডি) যাব আমরা। বিসিআরইসিএলের অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পাবনায় ৬৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরও একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি, যার কাজ চলমান। এ ছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় ৫০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পসহ আরও কয়েকটি নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে বিসিআরইসিএল। সৌরবিদ্যুতের জমিতে চাষাবাদঃ একসময় ধারণা করা হতো, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিচে কোনো ফসল আবাদ করা সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে বলা হতো, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্যানেল বসানোর ফলে এর নিচে তাপমাত্রা বেড়ে যায়; যা ফল-ফসল আবাদের পরিবেশকে নষ্ট করে। কিন্তু এই সমস্যা এখন আর নেই। নতুন গবেষণা বলছে, উঁচু প্যানেল বসিয়ে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপন করা হলে নিচে ফসল আবাদ করা সম্ভব। আর যে সৌর প্রকল্পের নিচে উদ্ভিদ থাকে, ওই কেন্দ্রের উৎপাদন দক্ষতা এক ভাগ বৃদ্ধি পায়। নিচে পানি থাকলে দক্ষতার হার আরও একটু বেশি হয়। দেশে প্রায় সব সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জমিই ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে কোনো ফসল আবাদ করা হয় না। নিচু করে সোলার প্যানেল বসানোর কারণে ফসল আবাদ করার সুযোগও তেমন নেই। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সিরাজগঞ্জ ৭ দশমিক ৬ মেগাওয়াট গ্রিড কানেক্টেড সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রটিতে উঁচু পিলারের ওপর সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। এর নিচে বিভিন্ন মৌসুমি শাকসবজি চাষ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর দক্ষিণে সয়দাবাদ ইউনিয়নের বড়শিমুল ও পঞ্চসোনা মৌজায় ২২ দশমিক ৭৮ একর জমিতে কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নিঃ বিদ্যুৎ খাতে সরকারের মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা থাকলেও সে লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে অনগ্রিড ও অফগ্রিড মিলিয়ে কমবেশি ৭১৬ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎসহ বায়ু ও জলবিদ্যুৎ মিলিয়ে দেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এখন প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলছে। যদিও সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বর্তমান সক্ষমতার অনুপাতে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়ার কথা।