আগুন কি শুধুই আলো, শক্তি, দীপ্তি, শান্তি আর তৃপ্তি নিয়ে আসে? কখনো কখনো আগুনের কালো ধোঁয়া চারদিক অন্ধকার করে দিয়ে শক্তি, শান্তি ও তৃপ্তি কেড়ে নিতে পারে এক নিমিষেই। আগুন হলো উত্তপ্ত গ্যাসের মিশ্রণ। এটি সৃষ্টি হয় রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে, যা প্রধানত বাতাসের মধ্যকার অক্সিজেন এবং বিভিন্ন ধরণের জ্বালানীর মধ্যে সংঘটিত হয়।তাই শক্তিরুপি আগুনের ব্যাবহার জানার পাশাপাশি ভয়ংকরী আগুন থেকে বাঁচার কৌশলও আমাদের জেনে নিতে হবে।
নিমতলী ট্র্যাজেডি, চকবাজার অগ্নিকাণ্ড, বনানীর অগ্নিকান্ড আর খুব সম্প্রতি বঙ্গবাজার অগ্নিকান্ডের বিভীষিকাময় ঘটনা যেন বাংলাদেশের সব মানুষকেই দগ্ধ করে দিয়েছে। ঈদের আগ মুহূর্তে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের ঈদে নতুন পোষাকের স্বপ্ন।
তাই কোথাও আগুন লেগে বহ্নিশিখা গ্রাসের ফলে জীবন সংকটাপন্ন অবস্থায় যা করণীয় তা জেনে রাখা উচিত আমাদের সকলকেই। যে কাজগুলো মাথা ঠাণ্ডা রেখে করলে আগুনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচা গেলেও যেতে পারে।। কারণ হঠাৎ আগুন লাগলে আমরা অনেকেই জানি না ঠিক কী করা উচিত। আবার অনেকেই আগুন লাগলে করনীয় কাজগুলো জানলেও ঘাবড়ে যাওয়ার কারণে কিংবা ভয় পেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
আগুনের ধরন ও নির্বাপণের উপায়
আগুন নিভাতে হলে আগে আগুনের ধরন জানতে হবে। কেননা গ্যাসের আগুন আপনি পানি দিয়ে নিভাতে পারবেন না। আগুনের উৎপত্তি, জ্বলার উপাদান… এগুলোর ভিত্তিতে আগুন সাধারনত ৪ ধরনের হয়ে থাকে-
১. সলিড ফায়ার (কাঠ, বাঁশ ইত্যাদির আগুন)
২. লিকুইড ফায়ার (তেল, পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদির আগুন)
৩. গ্যাস ফায়ার (গ্যাস লাইন, গ্যাসের চুলা ইত্যাদির আগুন)
৪. মেটাল ফায়ার (সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদির আগুন)
আগুনের ধরন বুঝে তা নেভানোর ব্যবস্থা নেয়াই হল অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা। কোথাও হঠাৎ আগুন লাগলে প্রথমেই ফায়ার সার্ভিসকে জানাতে হবে। তারপর নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস আসার আগে আগুনের ধরন বুঝে তা নেভানোর চেষ্টা করতে হবে।
১. সলিড ফায়ার নির্বাপণ
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ছিটিয়ে এ ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
২. লিকুইড ফায়ার নির্বাপণ
পানি দ্বারা এ ধরনের আগুন নেভানো যায় না। বরং পানি ব্যবহার করলে এ আগুন আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ ধরনের আগুনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস, ফোম, ড্রাই পাউডার… এগুলো বেশি কার্যকরী। তবে এগুলো কিছুই যদি না থাকে হাতের কাছে বালি থাকলে তা ছিটিয়ে দিয়েও এ ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
৩. গ্যাস ফায়ার নির্বাপণ
এ ধরনের আগুনে পানি একেবারেই অকার্যকর। কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস, ফোম, ড্রাই পাউডার ইত্যাদির সাহায্যেই এই আগুন নির্বাপণ করতে হয়।
৪. মেটাল ফায়ার নির্বাপণ
মেটাল ফায়ারও পানির সাহায্যে নেভানো যায় না। উপরোক্ত উপায়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস, ড্রাই পাউডার, ফোম, বালি ইত্যাদির মাধ্যমেই এ ধরনের আগুন নেভানো যায়। তবে হাতের কাছে যদি কম্বল, ছালার বস্তা, ভারী কাঁথা বা তোষক জাতীয় কিছু থাকে, তবে এগুলো দিয়ে চাপ দিয়েও এই আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর চেষ্টা করবেন এগুলো আগুনে দেয়ার আগে ভিজিয়ে নিতে। তাহলে দ্রুত কাজ হবে।
আগুন লাগলে করনীয়
এবার আসি বাসায়, অফিসে কিংবা বাইরে কোথাও হঠাৎ আগুন লাগলে একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের করনীয় কাজগুলো কী কী।
*মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রথমেই বিদ্যুতের সুইচ এবং গ্যাসের চুলা বন্ধ করার চেষ্টা করুন।পরিস্থিতি যতটা শান্ত রাখা যায়, বিপদ থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তত বেশি বাড়ে।
* কাছাকাছি ফায়ার সার্ভিসের অফিসে যোগাযোগ করুন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য- আপনার ফোনে বা হাতের কাছে সবসময় জরুরী ফোন নম্বরগুলো যেমন- নিকটস্থ পুলিশ অফিস, ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল… এগুলোর নম্বর রাখুন যাতে জরুরী পরিস্থিতে সাহায্য চাইতে পারেন। অথবা ৯৯৯ এই নাম্বারে ফোন দিয়েও সাহায্য চাইতে পারেন।
*বাসায় আগুন লাগলে আগুনের ধরন বুঝে তা নির্বাপণের চেষ্টা করুন। গ্যাসের চুলায় বা শর্ট সার্কিট থেকে আগুন ধরলে ভেজা কাঁথা, কম্বল বা বস্তা ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে দিলে আগুন নিভে যাবে।
*বাহিরে কোথাও হলে ফায়ার এক্সটিংগুইশার খুঁজে আগুনের উৎপত্তিস্থলে ব্যবহার করুন।
*আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে আসুন এবং অন্যদেরকেও সাহায্য করুন বের হয়ে আসতে।
*বাসা, অফিস, মার্কেট কিংবা যেকোনো জায়গাই হোক না কেন ভুলেও লিফট ব্যবহার করা যাবে না।
*যদি বের হয়ে আসার আগেই ধোঁয়ায় ঢেকে যায় তাহলে রুমাল কিংবা অন্য যেকোনো কাপড় দিয়ে নাক ঢেকে ফেলুন এবং সম্ভব হলে কাপড়টি অবশ্যই পানিতে ভিজিয়ে নিন। আগুনে যত মানুষ পুড়ে মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ মরে ফুসফুসে আগুন ঢোকার কারণে। ভিজা কাপড় দিয়ে নাক মুখ ভাল করে ঢেকে ফেললে বাইরের গরম বাতাস এবং ধোঁয়া শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসে খুব সহজে ঢুকতে পারে না। এতে আপনার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
*গায়ে আগুন লেগে গেলে দৌড়াবেন না। এতে বাতাসে আগুনের বেগ বেড়ে গিয়ে শরীরে আষ্টেপৃষ্টে আগুন লেগে যাবে। গড়িয়ে গড়িয়ে যেদিকে যেতে চান সেদিকে যান।
*কোন ব্যক্তি আগুনে পুড়ে গেলে তাকে এমনভাবে শুইয়ে দিতে হবে যাতে তার পুড়ে যাওয়া অংশ খোলা থাকে এবং পুড়ে যাওয়া অংশ থেকে কাপড় সরিয়ে দিতে হবে খুব সাবধানে। পুড়ে যাওয়া অংশে যদি কাপড় আটকে যায় তবে সেটা টানাটানি না করে শরীরের অন্য কাপড় কেটে ফেলতে হবে। তারপর ঠান্ডা পানি বা বরফ পানি (না থাকলে এমনি পানি) পোড়া জায়গায় ঢালতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে না নেয়া হয়। ক্ষতস্থানে কোনোভাবেই হাত দেয়া যাবে না কিংবা হাত দিয়ে ঘষা যাবে না।
*বৈশিষ্ট্যগত কারণে আগুন উপরের দিকে উঠে। তাই বহুতল বিল্ডিং-এর নিচের দিকের কোন ফ্লোরে আগুন লাগলে সিঁড়ির জায়গা দিয়েই আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরকম ক্ষেত্রে নিচে নামার সময় সতর্ক থাকুন। নিচে নামা না গেলে বিল্ডিং-এর খোলা ছাদে উঠে যাওয়া যেতে পারে। এতে ঝুঁকি কম থাকবে এবং উদ্ধার করাও সহজ হবে।
*ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পথ পরিহার করুন। যেতে বাধ্য হলে উপুড় হয়ে বা হামাগুড়ি দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করবেন। ধোঁয়া ওপরে ওঠে বলে নিচের বাতাসে অক্সিজেন বেশি থাকে।ধোঁয়ায় কিছু দেখা না গেলে ও একাধিক সদস্য থাকলে একজনের পেছনে আরেকজন হামাগুড়ি দেবেন, একে–অন্যের কাপড় বা পা ধরে এগোবেন।বিপদে কিছুক্ষণ পরপর একে–অপরকে সাহস দিলে বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
*ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্পর্কিত সেবা পেতে কল করুন: +০২-২২৩৩৫৫৫৫৫, ০১৭৩০-৩৩৬৬৯৯, ০১৭১৩-০৩৮১৮১-২ নম্বরে।
অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে এই বিষয়গুলি সবসময় আমাদের মাথায় রাখতে উচিত । আগুন যতটা না বিপদ ডেকে আনে, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে হুড়োহুড়ি বা তাড়াহুড়ো।সামান্য কিছু তথ্য জানা থাকলে বা একটু সতর্ক হলেই বাঁচানো যেতে পারে মূল্যবান জীবন ও সম্পদ।আগুন যেমন আমাদের অন্ধকার জীবনে আলো এনে দিতে পারে তেমনি পুড়ে ছাই করে দিতে পারে সকল স্বপ্ন তাই আগুনের ব্যাবহার সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকা উচিত।
লেখিকা: কপোতাক্ষী নূপুরমা সিঞ্চি,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।